ইফতারের বারোটা

হাবীব নূহ >>

বেশ ক’বছর আগের একটি ঘটনা।ইংল্যান্ডের একটি কমিউনিটি সেন্টারে অনেক মুসলিম জড়ো হয়েছেন।রামাদ্বানের সচেতনতা সৃষ্টির নিমিত্তে আয়োজন করা হয়েছে প্রোগ্রাম।সেখানে অধিকাংশ শ্রোতা বাংলাদেশী অরিজিন।ধরা যায় বাংলাদেশী ওডিয়েন্স।

রামাদ্বানের পর্যালোচনার পর যখন প্রধান ‘শাইখ’ শ্রোতাদের অনুভূতি ও ভাবনার কথা শুনতে শুরু করলেন।

তখন আড়াল থেক উচ্চ পদস্থ সরকারি চাকরিজীবী একজন মহিলা তাঁর অনেষ্টি(honesty) প্রকাশ করে প্রশ্ন করলেন, শাইখ! “সত্যি হল—আমি সাওম ধরতে পারি না, রোযা রাখতে পারি না।এখন আমাকে কি করতে হবে, বলুন? আমাকে এর পরিবর্তে কতটুকু টাকা দান করতে হবে অথবা কি করতে হবে বলে দিন।

তিনি আরো স্পষ্ট করে বললেন, আমি যেহেতু চাকুরি করি,অফিসে তো আর ইফতার করতে পারি না সেহেতু আমি সাওমও পালন করতে পারি না।এজন্য আমি ‘সরি’ আছি।রিয়েলি সরি।তবে আপনিই এখন বলুন আমার করণীয় কি? প্লিজ!

‘শাইখ’ জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি ইফতার বলতে কি বুঝেন? সেটি আগে খোলাসা হওয়া দরকার।”

জবাবে মহিলা বললেন “এই তো, আমার আম্মারা যে রকম সন্ধ্যা হলে খেজুর,খিচুড়ি,চানা, সামুসা ইত্যাদি দিয়ে টেবিল সাজিয়ে বসে দুআ-দুরুদ করেন, অতঃপর একসময় খেজুর খাইতে শুরু করেন,তা’ই তো ইফতারি এবং ইফতার।” 

‘শাইখ’ মহিলার কথা শুনে বললেন “বোন! আপনার অনেষ্টির(সততার) জন্য ধন্যবাদ।তবে আপনার খটকাটা কোথায় তা আমি বুঝতে পেরেছি।
আসলে বোন! ইফতার কি? প্রথমে সে বিষয়টি সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।অথবা সেটি শিখার প্রয়োজন।

বোন! আপনি যা প্রকাশ করেছেন, তা হল আমাদের ‘ট্রেডিশন’ ‘কলচার’ বা সংস্কৃতি ও কৃষ্টি।

এগুলো সবই যে ভুল,তা কিন্তু নয়।আবার এ গুলোই যে ইসলাম তাও কিন্তু নয়।

আমরা সাওম পালন করি শুধু আল্লাহর আদেশ মান্য করতে।সাওম কি ভাবে পালন করতে হবে, তা আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালন করে আমাদেরকে ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন।আপনি খাবারের যে পদগুলির কথা বললেন তা থেকে খেজুর ছাড়া অন্য কিছুই তো,আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইফতারিতেই শুধু নয়, বরং সাধারণ সময়েও কোন দিনই এ ভাবে খাননি তারপরও তিনি পৃথিবীর সেরা সাওম পালনকারী ছিলেন।”

অনেষ্ট মহিলা আশ্চর্য হলেন।অহ্ বলে বিস্ময় প্রকাশ করলেন।’শাইখ’ আরো বললেন ‘সাওম পালন ভিন্ন বিষয় আর ইফতার করা আলাদা বিষয়।দুটো ভিন্ন ভিন্ন আ’মল।

সাওমের সাথে ইফতারের সম্বন্ধ এরকম, যেমন আপনার শরীরের কাপড় পরা আর হাতের চুড়ি পরা।কাপড় পরা জরুরী আর চুড়ি পরা হল সৌন্দর্য।তেমনি সাওম পালন ফারদ্ব তথা অবশ্যই পালনীয়।পরন্তু ইফতার করা মুসতাহাব তথা সুন্নাহ।তার মানে ইফতার সারা বা করাটা ভাল কাজ।অত্যাবশ্যক কাজ নয়।ইফতার না করলে অন্যায় বা গোনাহ হবে না।তবে করতে পারলে অনেক কল্যাণ ও সাওয়াব আছে।

অনেষ্ট মহিলা,অহ্ বলে আরো তাজ্জব হয়েছেন সেটি জানান দিলেন।’শাইখ’ তাঁর কথা চালিয়ে গলেন।তিনি বললেন, সাওম শেষ হয়ে যায় মাগরিবের তথা সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে।এর অর্থ হল,সাওম মানে নির্দিষ্ট সময় পার করা।এই ধার্য করা সময়ের ভিতর, কিছু বিষয় থেকে বিরত থাকা হল সাওম।অবশ্য সাথে নিয়ত বা সংকল্পও থাকতে হবে।যখনই সূর্য, দিগন্ত থেকে পুরো আড়াল  হয়েছে বলে আপনার পুরো বিশ্বাস হবে তখনই আপনার সাওম পুরো হয়ে গেছে।এ সাওম পালন করা তেমন কঠিন নয়।এখানে মনোবলটাই বেশি দরকার।

আপনি যে কোন নির্জন দ্বীপে একাকী বসে অনায়াসে যেমন সাওম পালন করতে পারবেন তেমনি লোকালয়ের কোলাহল অথবা অফিসের গোলমালের মধ্যেও তা আদায় করতে পারবেন।যখনই সূর্যাস্ত হবে তখনই একটি সাওম সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।কিছু খান অথবা না খান।ইফতার করেন অথবা না করেন।ফজর থেকে শুরু হওয়া সাওমটি মাগরিবের সাথে সাথেই শেষ হয়ে যাবে।এমনকি মাগরিবের আযান শুনতে না পেলেও।এ ভাবে একজন মুসলিমের একটি সাওম পালনের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় সূর্যাস্তের পর।

‘শাইখ’ আরো অগ্রসর হয়ে বললেন, বোন! এবার ইফতার নিয়ে কথা বলছি শুনুন।

সারা রাত ঘুম শেষে প্রভাতে যখন কিছু খাবার খেলেন,এই খাদ্য গ্রহণ বা জলখাবারকে নাশতা বা প্রাতরাশ আর ইংরেজিতে Breakfast এবং আরবিতে ইফতার ও ফুতুর বলে।

তেমনি সারাদিন ‘নিষ্পুণ্য’ উপোস থাকার পর অথবা পূণ্যময় সাওম পালনের পর কিংবা নির্দিষ্ট বেলা ফুরালে পর,মাগরিবের সময় যে হালকা খাবার খাওয়া হয় সে খাবার গ্রহণের নামই breakfast অথবা ফুতুর কিংবা ইফতার।

যখন ইসলামী রোযার নিইয়াতে রোযা রাখা হবে তখন কিন্তু রোযার নির্দিষ্ট  সময় পার হওয়ার পরই ইফতার করতে হবে।সময়ের এক মুহূর্ত আগেও ইফতার করলে রোযা সঠিক হবে না।

এবং ইফতারিতে অতি সামন্য কিছু খেলেই ইফতার হয়ে যায়।এজন্য মস্ত বা ব্যাপক কোন আয়োজনের প্রয়োজন হয় না।যদিও হাল জামানায় সে ইফতারি আর হালকা থাকেনি বরং ভারি বা মহা-ভারী অথবা মেগা ভারি হয়ে গেছে।এখনকার সময়ের ইফতারি কিন্তু ভিন্ন ব্যাপার।এটি আমাদের গঢ়া ট্রেডিশন।

কথা বলার সময় শাইখ তাঁর ডান কনুইকে টেবিলে ঠেকিয়ে, হাত উঁচু করে এবং হাতের আঙুল দিয়ে চেপে ধরে একটি কলম নাড়াচ্ছিলেন।অর্থাৎ কলমটি নাড়াতে নাড়াতে শাইখ কথা বলছিলেন।এক সময় শাইখের হাত ক্লান্ত হয়ে যায়।হয়ত সে কারণেই হঠাৎ হাতের কলমটি খসে পড়ে শাইখের হাত থেকে।’শাইখ’ কথা বন্ধ করে দিয়ে মেঝের দিকে তাকালেন।কেউ একজন কলমটি কুড়িয়ে দিলেন।’শাইখ’ আবার বুঝাতে শুরু করলেন।

তিনি বলতে লাগলেন, ইফতার খাওয়া ছাড়াও সাওম পালন হয়ে যায় তাতে কোন সন্দেহ নেই।তবে ইসলামে ইফতার খাওয়াকে খুবই উৎসাহিত করা হয়েছে।আবার রোযার নির্দিষ্ট সময় পুরো হয়ে গেলে পর দ্রুত ইফতার করাকেও উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।ইফতার করে নেওয়াটা ভাল এবং পূণ্যের কাজ।অতিরিক্ত সাওয়াবের আ’মল।তবে মনে রাখা চাই যে, সাওম নির্ভর নয় ইফতারের উপর।সাওম পালনের জন্য ইফতারকে শর্ত হিসেবেও ধরা হয়নি।তাই, ইফতার খাওয়া ছাড়াও সাওম পালনে কোন সমস্যা নেই। 

শেষ করার আগে, ‘শাইখ’ একটি উপমা দিয়ে বলতে লাগলেন—“ধরুন,নুমায়ের নামের একটি লোক, অফিস শেষ করে ঠিক ইফতারের সময় বাসায় রওয়ানা হলেন এবং তিনি একটি বাসে চড়লেন।রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে পড়ে গেলেন, সেকারণে বাসায় পৌঁছতে তাঁর তিন ঘন্টা দেরি হল।এখন এই যে তিন ঘন্টা তিনি অতিরিক্ত সময় সাওম বা রোযা পালনের মত কাঠালেন।কিছুই খেলেন না।তাঁর সেই সময়টুকু কি সাওম পালনের মধ্যে গণ্য হবে? তিনি কি অন‍্যদের থেকে বেশি সময় রোযা রেখেছেন? উত্তর হবে নিশ্চয় এ সময়টুকুকে সাওম ধরা হবে না।কারণ—তাঁর সাওম তো তিন ঘন্টা আগেই পূর্ণ হয়ে গেছে অর্থাৎ মাগরিবের সাথে সাথে তাঁর রোযা পুরা হয়ে গেছে।যদিও তিনি,কিছুই খাননি।

‘শাইখ’ বললেন, তবে,নুমায়ের এখানে একটু চালাকি করতে পারতেন।আর তা হল,নুমায়ের যদি ঐ সময়ে পকেট থেকে একটি চুইংগাম অথবা চকোলেট বের করে মুখে পুরে নিতেন, তাহলে তো তখন সাওম পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে তাঁর ইফতারও হয়ে যেত।বাসা-বাড়ির সাজানো ইফতার থেকে বাসে ঝুলন্ত নুমায়ের হয়ত আরো বেশি সাওয়াবও পেয়ে যেতেন।

‘শাইখ’ অনুরোধ করে বললেন, সাহস করে রোযা রাখার চেষ্টা করুন।এটি মুসলিম হিসেবে আপনার দায়িত্ব।ইফতার না করতে পারলেও।তবে ইফতার করার কোন না কোন সুযোগ আপনার নিশ্চয় থাকবে।অফিসে একটু পানি পান করলেই তো ইফতার হয়ে যাবে।

অনেষ্ট মহিলা বললেন, “ধন্যবাদ  শাইখ! কখনো এরকম শুনিনিতো অথবা শুনার চেষ্টাও করিনি এজন্য আমার কাছে রোযা খুব কঠিন কিছু মনে হত।বিশেষ করে ইফতার এবং সাহরি।এবার বুঝতে পারলাম যে,ব্যাপারটা এত শক্ত কিছু নয়।আসলে, ইসলামকে শিখা এবং জানার নিতান্ত দরকার আছে।এখন থেকে আমি সাওম পালনে সচেষ্ট হবো। আবারও আপনাকে ধন্যবাদ।”

শাইখ বললেন, ধন্যবাদ আপনাকেও। বিশেষ করে, ধন্যবাদ আপনার প্রশ্নের জন্য।তাতে ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে গেল।

লেখক পরিচিতি : 
চেয়ারম্যান : নাসিহা ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ
সি.ই.ও : নাসিহা ফাউন্ডেশন বিডি, ইংল্যান্ড
উপদেষ্টা, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইংল্যান্ড
সিনিয়র সহসভাপতি, হেফাজতে ইসলাম, ইংল্যান্ড