কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :
সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণ এবং চাঁদাবাজি-ছিনতাইয়ের দুটো মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালেই সম্পন্ন হবে। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সোমবার (১৭ মার্চ) বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
উচ্চ আদালতে এ মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল কাইয়ুম লিটন বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের বালুচর এলাকার এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক নারী। কলেজের গেট থেকে স্বামীসহ তাকে ধরে ছাত্রাবাসে এনে স্বামীকে বেঁধে নারীকে ধর্ষণ করে ছাত্রলীগের কর্মীরা। এ ঘটনায় তার স্বামী বাদী হয়ে মহানগর পুলিশের শাহপরান থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং দুজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করেন।
ব্যারিস্টার আব্দুল কাইয়ুম লিটন জানান- চাঞ্চল্যকর মামলাটি শুনানির জন্য বাদী পক্ষ থেকে আমি আদালতে আবেদন করেছিলাম। বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল (এজি) থেকে এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়া হয়। যেহেতু বিগত দিনে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার লিভ টু আপিল করায় প্রায় তিন বছর ধরে মামলার বিচার কাজ বন্ধ ছিল। বর্তমান এজি অফিস এই আপিল প্রত্যাহার করে নিতে আবেদন করেন। সোমবার এ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে আদালত এটি নন-সেনআপ আদেশ দেন। এর মধ্য দিয়ে মামলা দুটো দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠাতে আর কোনো বাধা না। বিধান অনুযা আগামী ৩০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশ করে নথিপত্র দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠাতে হবে।
জানা গেছে, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির আপিল বেঞ্চে করা রাষ্ট্র পক্ষের প্রত্যাহার আবেদনের উপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আরশাদুর র শুনানি করেন। রিটের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুল কাইয়ুম, ব্যারিস্টার ওমর ফারুক এ ব্যারিস্টার কামারুন মাহমুদ দীপা। শুনানি শেষে আদালত আদেশ দেন।
বাদী পক্ষের আইনজীবী প্যানেলের প্রধান অ্যাডভোকেট শহীনুজ্জামান চৌধুরী বলেন, উচ্চ আদালত যে আদেশ দিয়েছেন এর ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মামলা উল্লেখ করে নতুন করে গেজেট প্রকাশ করতে হবে। তারপর নথিপত্র দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করতে হবে। এরপর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করার বিধান রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের জুন মাসে নজিরবিহীনভাবে তৎকালীন এজি অফিস থেকে গণধর্ষণের ঘটনার দুই মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বদলি করতে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়। ওই সময় এজি অফিস আসামিদের রক্ষায় এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে অভিযোগ উঠলেও সরকারের আইন মন্ত্রণালয় কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণই করেনি। আসামিদের রক্ষায় বছরের পর পার হলেও কার্যত মামলার বিচার কার্যক্রমের কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০২৩ সালের ২৬ জুন আপীল বিভাগের এডভোকেট অন রেকর্ড হরিপদ পাল স্বাক্ষরিত এক পত্রে বাদীপক্ষের আইনজীবী এডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরীকে লিভ টু আপিল দায়েরের বিষয়ে নোটিশ দিয়ে জানানোর পর থেকে আসামিদেরকে সিলেটের আদালতেও তেমন একটা হাজির করা হয় না। কিন্তু ৫ আগস্টের পরবর্তী প্রেক্ষাপটে এমসি কলেজের গণধর্ষণের মামলার বিষয়ে দৈনিক সিলেটের ডাকসহ গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ গণধর্ষণ ও চাঁদাবাজির মামলা দুটো দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের চূড়ান্ত আদেশ দেন।ওই আদেশে ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে গেজেট জারি করতেও বলা হলেও শুধুমাত্র তৎকালীন এজি অফিসের কারণে হাইকোর্টের ওই আদেশ বাস্তবায়ন হয়নি। এর আগে ১ আগস্ট বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে বাদীপক্ষ একটি রিট দায়ের করলে ১৬ আগস্ট দুই মামলার বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বদলির জন্যে প্রক্রিয়া গ্রহণে কেন নির্দেশনা দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক মামলার জেলা মনিটরিং কমিটির সভায় আলোচিত গণধর্ষণ মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও এরপর আর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহিতুল হক আট আসামির উপস্থিতিতে ২০২২ সালের ১১ মে বুধবার গণধর্ষণের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা চাঁদাবাজি ও ছিনতাই মামলার অভিযোগ গঠন করেন। এর আগের বছর ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি রোববার ওই ট্রাইব্যুনালে সকল আসামির উপস্থিতিতে অপহরণ, গণধর্ষণ ও গণধর্ষণে সহায়তার অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অভিযোগ গঠন করা হয়। পণধর্ষণ মামলার অভিযোগ গঠনের পর ওই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করলেও বাদীপক্ষ উচ্চ আদালতে এক সাথে একই আদালতে মামলা দু'টির চালানোর আবেদন করায়, আবেদনটির সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে যাননি। এদিকে, ২০২৩ সালের ২৭ জুলাই আসামি রবিউল ইসলামের জামিন শুনানিতে মামলার বিচার বিলম্বিত হওয়ায় উম্মা প্রকাশ করেন বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
সেই ধর্ষকদের পরিচয় গণধর্ষণের ঘটনায় সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার চান্দাইপাড়ার তাহিদ মিয়ার পুত্র সাইফুর রহমান (২৮), হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বাগুনীপাড়ার শাহ জাহাঙ্গির মিয়ার পুত্র শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার উমেদনগরের মৃত রফিকুল ইসলামের পুত্র তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), জকিগঞ্জের আটগ্রামের মৃত অমলেন্দু লস্কর ওরফে কানু লক্ষরের পুত্র অর্জুন লস্কর (২৬), দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুরের দেলোয়ার হোসেনের পুত্র রবিউল ইসলাম (২৫), কানাইঘাট উপজেলার লামা দলইকান্দির (গাছবাড়ী) সালিক আহমদের পুত্র মাহফুজুর রহমান মাসুম (২৫), সিলেট নগরীর গোলাপবাগ আবাসিক এলাকার (বাসা নং-৭৬) মৃত সোনা মিয়ার পুত্র আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল (২৬) ও বিয়ানীবাজার উপজেলার নটেশ্বর গ্রামের মৃত ফয়জুল ইসলামের পুত্র মিজবাউল ইসলাম রাজনকে (২৭) অভিযুক্ত করে ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর দন্ডবিধি আইনের৩৪২/৩২৩/৩৭৯/৩৮৫/৩৪ ধারা তৎসহ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী, ২০০৩) এর /৭/৯/(৩)৩০ ধারায় অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে পুলিশ। এতে ৫২ জনকে সাক্ষী রাখা হয়। ঘটনার মাত্র ২ মাস ৮ দিন পর ১৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি আদালতে জমা দেয়া হয়। এদিকে, ছাত্রাবাস থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় সাইফুর রহমান ও শাহ মাহবুবুর রহমান রনিকে আসামী করে ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ১৯/১৯এ ধারায় অভিযোগপত্রটি জমা দেয়া হয়। ঘটনার ১ মাস ২৭ দিন পর অস্ত্র মামলার অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ ।
গণধর্ষণের পর আইনশৃংখলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ধর্ষকদের গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত আট ধর্ষকের সকলেই ছাত্রলীগের টিলাগড় গ্রুপের গডফাদার রনজিত সরকারের অনুসারী। গ্রেফতারের পর ৮ আসামির সকলেই আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। আসামিদের মধ্যে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, মিজবাহুল ইসলাম রাজন ও আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ১৯ বছর বয়সী ওই নববধুকে সরাসরি গণধর্ষণ করে। রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুম ধর্ষণে সহযোগিতা করে। ঘটনার পরে গ্রেফতারকৃত ৮ আসামির প্রত্যেকের ডিএনএ নমুনা ওসমানীর ওসিসির মাধ্যমে সংগ্রহ করে ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে প্রেরণ করে পুলিশ।
ডিএনএ রিপোর্টে ছাত্রলীগ নেতা সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর ও মাহবুবুর রহমান রনির ডিএনএ 'ম্যাচিং' পাওয়া যায়। এদিকে আইনুদ্দিন ও মিসবাহ উদ্দিন রাজন'র ডিএনএ 'মিক্সিং' পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। ডিএনএ রিপোর্ট'র ফলে নিশ্চিত হওয়া যায়, এই ৬ জনই গৃহবধূকে ধর্ষণ করেছিল। আইনুদ্দিন ও মিসবাহ ধর্ষণের সময় ‘কিছু ব্যবহার করায়’ ম্যাচিং এর বদলে রিপোর্টে মিক্সিং পাওয়া যায়। বাকী ৪ জন 'কোনো কিছু ব্যবহার না করে সরাসরি ধর্ষণ করে বলে নিশ্চিত হয় সিআইডি। গ্রেফতারের পর আদালত তাদের প্রত্যেককে ৫ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিমান্ড শেষে ৮ আসামীর সকলেই জবানবন্দিতে গৃহবধূকে তুলে নেয়াসহ গণধর্ষণ ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। ঘটনার পর থেকে আসামিরা সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রয়েছে।
মূল রিপোর্ট : সিলেটের ডাক