সারবাহী জাহাজে কুপিয়ে ও গলা কেটে ৭ জনকে হত্যা
ফোনের কললিস্ট ধরে তদন্ত
কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :
সারবাহী জাহাজ এমভি আল-বাখেরার সাত কর্মচারীকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। চাঁদপুরের হাইমচরে মেঘনা নদীতে থেমে থাকা জাহাজটির বিভিন্ন কক্ষ থেকে গতকাল সোমবার দুপুরে পাঁচজনের রক্তাক্ত লাশ ও তিনজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও দু’জন মারা যান। গুরুতর আহত একজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
তবে কারা, কেন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে– সে রহস্য এখনও ভেদ করা যায়নি। প্রাথমিকভাবে ডাকাতির কথা বলা হলেও সেখান থেকে কিছু লুট হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে পারেননি কেউ। জাহাজটির মালিকপক্ষ ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে।
পুলিশ সূত্র বলছে, রোববার রাতে জাহাজটি নোঙর করা অবস্থায় এ ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তরা জাহাজে থাকা আটজনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। এতে সেখানেই পাঁচজন মারা যান। জাহাজে হত্যার শিকার সবাই আলাদা কেবিনে ছিলেন। সেখানেই তাদের মেরে ফেলা হয়। তিনজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে আরও দু’জন মারা যান। তাদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে ছয়জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন– জাহাজটির মাস্টার ফরিদপুর সদরের গোলাম কিবরিয়া, তাঁর ভাগনে সবুজ শেখ, ইঞ্জিনচালক নড়াইলের মো. সালাউদ্দিন, সুকানি আমিনুল মুন্সি, গ্রিজার মো. সজিবুল, স্টাফ মো. আজিজুল ও মো. মাজেদুল। আহত ব্যক্তির গলা কাটা থাকায় তিনি কথা বলতে পারছেন না। কাগজে লিখে জানিয়েছেন, তাঁর নাম জুয়েল রানা, বাড়ি ফরিদপুর।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পণ্যবাহী জাহাজ এমভি আল-বাখেরা চট্টগ্রাম থেকে সার নিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীর দিকে যাচ্ছিল। রোববার রাতে হাইমচরে মেঘনা নদীর ইশানবালা খালের মুখে নোঙর করা ছিল জাহাজটি। সেখানেই রাতের কোনো এক সময় দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেয়ে বিকেল ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। সেখান থেকে আহত তিনজনকে উদ্ধার করে নেওয়া হয় চাঁদপুর সদর হাসপাতালে। তাদের মধ্যে দু’জনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
নৌ পুলিশের চাঁদপুর জেলার সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে, তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তবে ডাকাতি বলে মনে হচ্ছে না। বিরোধের জের ধরেও এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। এরই মধ্যে দুটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। এসব ফোনে থাকা কললিস্ট ধরে তদন্তকাজ চলছে।
চাঁদপুর জেলা নৌ পুলিশের এসআই শেখ আবদুর সবুর বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ডাকাতির উদ্দেশ্যে জাহাজে আক্রমণ করা হয়। ডাকাতিতে বাধা দেওয়ায় জাহাজকর্মীদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে খুন করা হয়।
তবে কোস্টগার্ডের স্টাফ অফিসার (ঢাকা অঞ্চল) লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামস জানান, নৌযানে থাকা সার খোয়া যায়নি। সে কারণে মনে করা হচ্ছে, ঘটনাটি ডাকাতি নয়। শত্রুতা থেকে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে দাবি করেছে নৌযানটির মালিকপক্ষ।
চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মহসীন উদ্দিন খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান। তিনি জানান, চাঁদপুরে এমন ঘটনা এটিই প্রথম। বিষয়টি ডাকাতি, না অন্য কিছু– বলতে পারছি না। জাহাজে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে যে একজন বেঁচে আছেন, তাঁর কাছ থেকেও আমরা কিছু জানতে পারিনি। অনেক সময় নিজেদের মধ্যেও কিছু ঘটনা ঘটে যায়। এটি এমন কিনা– সংশ্লিষ্টরা তদন্ত করবেন।
যেভাবে জানা গেল ঘটনা :
কার্গো জাহাজটি গত রোববার সকাল ৮টার দিকে চট্টগ্রামের কাফকো সার কারখানার ঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। তবে জাহাজটি যথাসময়ে ঢাকায় পৌঁছেনি। এতে সন্দেহ হয় মালিকপক্ষের। জাহাজের অবস্থান এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনে গতকাল তারা জরুরি পরিষেবা ৯৯৯-এ ফোন করেন। এ ফোন পেয়ে কোস্টগার্ডের চাঁদপুর স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট ফজলুল হক, নৌ পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবদুল্লাহ আল মামুন ও সহকারী পুলিশ সুপার মো. ইমতিয়াজ ঘটনাস্থলে যান। তারা যখন জাহাজটিতে উঠেছিলেন, তখন ইঞ্জিন বন্ধ ছিল।
জাহাজটির মালিক শামীমুর রহমার শিপন জানান, রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকে জাহাজটির চালকের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়। তখন জাহাজ মেঘনা নদীতে ছিল। তবে সকালে তিনি ফোন করে কারও সাড়া পাননি। তখন তিনি আরেকটি জাহাজের নাবিকদের বিষয়টি জানান। ওই জাহাজটি এমভি আল-বাখেরার কাছে যাওয়ার পর হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জানা যায়।
লিখে জানালেন– তিনি জুয়েল :
আহত জুয়েল রানা এ ঘটনায় পুলিশকে কিছু একটা বলতে চেয়েও শ্বাসনালি কাটা থাকায় পারেননি। তবে লিখে জানিয়েছেন, তাঁর নাম জুয়েল রানা। পরে সোমবার সন্ধ্যায় তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় নেওয়া হয়।
চাঁদপুর নৌ থানার ওসি একেএম ইকবাল বলেন, ‘আহত জুয়েলের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তিনি কথা বলতে পারেননি। শুধু কাগজে তাঁর নাম আর একটি ফোন নম্বর দিতে পেরেছেন।’
জুয়েলকে রাত পৌনে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাঁকে ভর্তি করা হয়েছে নাক-কান-গলা বিভাগে। সেখানকার মেডিকেল অফিসার সিরাজ সালেক বলেন, জুয়েল রানার শ্বাসনালি কেটে যাওয়ায় সেখানে একটি টিউব যুক্ত করা হয়েছে। তিনি এখনও শঙ্কামুক্ত নন।
আঘাতের চিহ্ন গলা ও মাথায় :
ঘটনাস্থলে যাওয়া কোস্টগার্ডের চাঁদপুর স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট ফজলুল হক বলেন, গলাকাটা অবস্থায় পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করি আমরা। তাদের শরীরে দেশি অস্ত্র দিয়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। গলার পাশাপাশি আঘাতের চিহ্ন আছে মাথায়ও। আহত তিনজনের একই অবস্থা ছিল।
চাঁদপুর হাসপাতালের চিকিৎসক আনিসুর রহমান বলেন, হতাহতদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখমের চিহ্ন রয়েছে। মৃতদের কারও কারও গলা কাটা ছিল।
ডাকাতি, না অন্য কিছু :
জাহাজটির মালিক মেসার্স দৃষ্টি এন্টারপ্রাইজ। এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার শামীমুর রহমার শিপন বলেন, প্রাথমিকভাবে এটিকে ডাকাতি বলে ধারণা করছে পুলিশ। সার ও তেল লুট করার উদ্দেশ্যে এটা হতে পারে। তবে এ ঘটনার পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে। কারণ এ ধরনের জাহাজে ডাকাতি করার মতো মূল্যবান কোনো জিনিস থাকে না।
বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাঈদ আহমেদ জানান, প্রাথমিকভাবে জেনেছি, জাহাজ থেকে তেল চুরি হয়েছে। তবে সার অক্ষত।
চালক-যাত্রীর মধ্যে আতঙ্ক :
এদিকে কার্গো জাহাজে সাত খুনের খবরে মেঘনা নদীপথ ব্যবহারকারী সাধারণ যাত্রী ও লঞ্চচালকের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। লক্ষ্মীপুর-ভোলা নৌপথে চলাচলকারী যাত্রীরা লঞ্চে উঠেও নেমে আসেন। পরে বিকেলে যাত্রী ও নৌযান চালকদের নিরাপত্তায় লক্ষ্মীপুর-ভোলা ও বরিশাল নৌপথে সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন নৌ পুলিশের সদস্যরা।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি :
আল বাখেরা জাহাজে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। সোমবার মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক এবং যুগ্ম সচিবকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে- হত্যাকাণ্ডের কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও দায়-দায়িত্ব নিরূপণ; অনুরূপ নৌ দুর্ঘটনা রোধে ভবিষ্যতে করণীয় নির্ধারণপূর্বক সুস্পষ্ট সুপারিশসহ আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে।
মূল রিপোর্ট : সমকাল