কওমি কণ্ঠ রিপোর্টার :
ড. মিজানুর রহমান আজহারি। ওয়াজের ময়দানে সুবক্তা। তুমুল জনপ্রিয়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও জেনারেল শিক্ষিতদের মাঝে। কিন্তু বক্তব্যের সময় প্রায়ই বিতর্কিত শব্দচয়নের কারণে হন সমালোচিত। সিলেটে তাঁর ওয়াজ মাহফিলের ঠিক আগমুহুর্তে তিনি রাসুল সা.-এর শানে ‘কাউবয়’ শব্দ ব্যবহার করে আবারও সমালোচনার মুখে পড়ছেন। ভার্চুয়াল মাধ্যম ফেসবুকে দু-তিন ধরে চলছে মিজানুর রহমান আজহারিকে নিয়ে আলোচনা-সালোচনার ঝড়।
সম্প্রতি আজহারির একটি ওয়াজ মাহফিলের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এতে দেখা যায়- নবিজি (সা.)-এর শৈশবের রাখাল জীবনের বর্ণনা দিতে তিনি ‘কাউবয়’ (রাখাল) শব্দটি ব্যবহার করেন।
নবি সা.-এর শানে এমন শব্দ ব্যবহারকে বেয়াদবি বা দৃষ্টতা বলে আলেম-সমাজের বক্তব্য। ওয়াজের নামে এমন অশালীন ও অনুপযুক্ত শব্দ ব্যবহারের জন্য তাঁকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতেও অনেকে আহ্বান করেছেন।
আবু তালহা তোফায়েল নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘জামাত চেষ্টা করছে সাঈদীর গ্যাপ ফিলাপ করতে ৷ কিন্তু তিনি (আজহারী) সিক্সপ্যাক থেকে কাউবয়— মন যা চাচ্ছে, তাই বকে যাচ্ছেন। জাতি সাবধান থাকুন।’
হাসিব আর রহমান নামের একজন লিখেছেন, ‘আজহারী সাহেবকে দেখতে পার্সিয়ান বিলাইর মত দেখা যায়। কারণে তাকে যদি কেউ 'মিয়াউবয়' বলে, তখন যারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাউবয় বলার কারণে কিছু বলে নাই তারাও কমেন্টে চ্যাইতা যাইব। দলীয়ভাবেই চ্যাইতা যাইব।’
আরজু আহমেদ নামের একজন লিখেছেন, ‘জনপ্রিয়তা শুদ্ধতার দলিল না। ফলে মিজানুর রহমান আজহারী যখন রাসুল (সা.) প্রসঙ্গে বলেন তিনি ‘কাউবয়’, খাদিজাতুল কুবরার ‘কর্মচারী’ ছিলেন- এইসব কথা তিনি ভুলই বলেছেন। কিন্তু তার ভুলের বাড়তি সমস্যা হলো, এ ভুল ব্যাপক বিস্তৃতি পায়। আর মানুষ সেটাকে ভুল বলে মানতে চায় না।’
‘ইসলামের ইতিহাসে পেশাদার বক্তাদের ‘কাসসাস’ (Story Teller) বলা হত। ইবনুল জাওযির মতে, এরাই ইলমে হাদিসের সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি করেছে। ইবনে উমার (রা.) মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলতেন, এই বক্তাদের জন্যই আমি মসজিদ থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হই, এদের ছাড়া আর কিছুই আমাকে মসজিদ থেকে দূরে রাখতে পারত না।’
শব্দচয়নে আজহারীকে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে সাইদ আল হাসান শিমুল নামের এক সাংবাদিক লিখেছেন- ‘এটা ঠিক যে, কাউবয় বলতে ওয়েস্টার্ন দুর্ধর্ষ অস্ত্রবাজ অশ্বারোহী ভেসে উঠে কল্পনায়। যারা কথায় কথায় খুন-খারাপি করতো। তাই শব্দচয়নে মিজানুর রহমান আজহারীকে আরও সতর্ক হতে হবে। শাব্দিক অর্থেই সব হয় না।’
নাজমুল ইসলাম কাসেমি নামের এক তরুণ আলেম লিখেছন- ‘ড. মিজানুর রহমান আজহারি ভাইয়ের সাথে আমার আজও সরাসরি মোলাকাত হয়নি। ইনশাআল্লাহ সামনে হয়তো হয়ে যাবে। যদি কখনো হয়, এইটা বলার ইচ্ছে ছিল- আল্লাহ আপনাকে অনেক পাণ্ডিত্য দিয়েছেন। আপনার মা'লুমাত অনেক। উপস্থাপনাও দারুণ!
আপনি অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠানে পড়েছেন। যদি সম্ভব হয়; সীমিত সময় হলেও কিছুদিন শায়েখ মাওলানা আব্দুল মালেক হাফি,.-এর সান্নিধ্য ও পরামর্শ নিয়ে দাওয়াতি কাজ কন্টিনিউ করুন; আপনার পরিবর্তনটা আর ব্যক্তিত্বটা আগামী অন্তত ১০০ বছরের জন্য মুত্তাবা হয়ে যাবে। পাশাপাশি, তাসাউফকেও ঠিক এভাবে কোনো দুনিয়া বিমুখ ওলির সান্নিধ্যে শাণিত করিয়ে নিন। এর পর থেকে আপনার ইলমের রুসুখতা দারুণভাবে মজবুত হবে। এবং আপনার মুখ থেকে তখন মেপে মেপে শুধু হীরে বের হবে। তাসামুহও আপনাকে কম স্পর্শ করবে। ইনশাআল্লাহ।’
ইসলামি লেখক-গবেষক মাওলানা লুৎফর ফারাজি লিখেছেন- ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাউবয় বলা চরম দৃষ্টতা ও বে-আদবি। তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা আবশ্যক।’
এর আগে মিজানুর রহমান আজহারি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শারীরিক গঠনের বর্ণনা করতে গিয়ে ‘সিক্সপ্যাক’ ও হযরত খাদিজা রা.-এর বিবাহিত জীবন বুঝাতে গিয়ে ‘ভার্জিন নন’ এমন সব শব্দ ব্যবহার করে আলেম-সমাজের বেশ তোপের মুখে পড়েন। এরপর দীর্ঘদিন মালয়েশিয়াতে পড়াশোনার কাজে থাকায় অনেকেই মনে করেছিলেন- এবার হয়তো শব্দচয়নে আজহারি সতর্ক হবেন। কিন্তু না হওয়ায় হতাশ হয়েছেন তারা।
মিজানুর রহমান ১৯৯০ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার ডেমরায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস কুমিল্লার মুরাদনগরের পরমতলা গ্রামে। তার বাবা একজন মাদ্রাসার শিক্ষক। তার পরিবারে মা-বাবা ও এক ভাই রয়েছে।
মিজানুর রহমান ঢাকার ডেমরায় অবস্থিত দারুন্নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে ২০০৪ সালে দাখিল, ২০০৬ সালে আলিম পরীক্ষায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ২০০৭ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন আয়োজিত মিসর সরকারের শিক্ষাবৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েট করার জন্য মিসরে যান। সেখান থেকে ডিপার্টমেন্ট অব তাফসির অ্যান্ড কুরআনিক সায়েন্স থেকে ২০১২ সালে শতকরা ৮০ ভাগ সিজিপিএ নিয়ে অনার্স উত্তীর্ণ হন।
মিসরে পাঁচ বছর শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করার পর ২০১৩ সালে মালয়েশিয়া যান। সেখানে গার্ডেন অব নলেজ খ্যাত ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট-গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব কোরআন অ্যান্ড সুন্নাহ স্টাডিজ থেকে ২০১৬ সালে পোস্ট-গ্রাজুয়েশন শেষ করেন।
২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে আজহারি তাঁর ওয়াজে ‘সিক্সপ্যাক’-‘ভার্জিন’ এসব শব্দ ব্যবহারের পর তোপের মুখে পড়ে দেশ ছাড়েন। প্রায় সাড়ে ৪ বছর মালয়েশিয়ায় কাটিয়ে চলতি বছরের ২ অক্টোবর দেশে ফিরেন তিনি। পরে ৯ দিনের মাথায় আবারও মালয়েশিয়ায় গিয়ে ১১ অক্টোবর দেশে আসেন।
বর্তমানে বিভাগভিত্তিক ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন আজহারি। আগামী ৯, ১০ ও ১১ জানুয়ারি সিলেট এমসি কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিতব্য ওয়াজ মাহফিলে তাঁর বক্তব্য রাখার কথা রয়েছে।