হেফাজত নেতা কে নি র্ম ম নি*র্যা*ত*ন

  • আওয়ামী লীগের দু:শ্বাসন

কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :

পবিত্র রমজানে শত শত মুসল্লি নিয়ে তারাবির নামাজ পড়িয়ে বেশ ক্লান্ত ইমাম। একটু বিশ্রামের প্রস্তুতি নিতেই তিনি দেখেন মসজিদটি ঘিরে ফেলেছে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। ছড়িয়ে পড়ে গ্রেপ্তার আতঙ্ক।

পুরো এলাকায় পুলিশি কর্ডন আর অঘোষিত রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। একপর্যায়ে গভীর রাতে চতুর্থতলায় উঠে সন্ত্রাসীর মতো গ্রেপ্তার করা হয় রাজধানীর নিউমার্কেট অ্যারোপ্লেন মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা সানাউল্লাহকে। পরে সন্ত্রাস দমনের আইনে মামলা দিয়ে নেওয়া হয় সাত দিনের রিমান্ডে। আর সেই মামলার জাল থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘ ছয় মাস জেলে কাটাতে হয় তরুণ এই আলেমকে।

শুধু নিজেই নির্যাতনের শিকার হননি মাওলানা সানাউল্লাহ। তাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের অত্যাচারে ঘরছাড়া হয়েছিলেন তার বৃদ্ধ দাদা-দাদি ও মমতাময়ী মা। জামিনে মুক্তির পরও অব্যাহত ছিল পুলিশ ও গোয়েন্দা হয়রানি। যে কারণে মসজিদের খতিবের চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন তিনি।

নিউমার্কেট মাদরাতুন নাজাতের প্রিন্সিপাল মাওলানা সানাউল্লাহ খান জানান, বিগত আওয়ামী সরকারের সময়ে মূলত ২০১৩ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেশের আলেম-ওলামারা ব্যাপক জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেকে শাহাদাত বরণ করেছেন, অসংখ্য আলেম গ্রেপ্তার হয়েছেন। পঙ্গুত্ববরণসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা। তারই অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ২০ এপ্রিল তাকে সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়।

তিনি বলেন- যারা ইসলামের কথা বলেন, হকের পক্ষ নেন, তাদের সেই কথা থামিয়ে দিতেই আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের আগে থেকেই তিনি ছিলেন গোয়েন্দা নজরদারিতে। আশঙ্কা করছিলেন গ্রেপ্তারের। কারণ ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি প্রচুর লেখালেখি করতেন।

২০ এপ্রিল আট রমজানের তারাবি পড়িয়ে মসজিদেই অবস্থান করছিলেন মাওলানা সানাউল্লাহ খান। হঠাৎ দেখতে পান নিউমার্কেট থানার একটি গাড়ি মসজিদের সামনে অবস্থান করছে। তিনি কী করবেন ভেবে মসজিদেই অবস্থান রেন। রাত ১১টায় তারাবি শেষ হওয়ার পর থেকে ২টা পর্যন্ত তিনি সবাইকে পুলিশের উপস্থিতির বিষয়টি জানান। ওই সময় এত আতঙ্ক যে, কেউ তাকে সহযোগিতা করার মতো ছিল না। আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলেন তিনি। ফেসবুকেও স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, এই মুহূর্তে আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আর কোনো সাহায্য নেই।

একপর্যায়ে শুধু নিউমার্কেট নয়, শাহবাগ, পল্টন থানা-পুলিশের গাড়িও মসজিদের পাশের পুরো সড়কে অবস্থান নেয়। গাউছিয়া মার্কেটের পাশ থেকে বাটা সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কে রেড অ্যালার্ট জারি করে জড়ো হয় ২০-৩০ গাড়ি পুলিশ। আড়াইটার দিকে চারতলায় তার রুমে ঢোকে পুলিশ। মসজিদের কোনো পবিত্রতাকে আমলে না নিয়ে বুট পায়ে মসজিদে প্রবেশ করে এবং একজন আলেম হিসেবে যে সম্মান পাওয়ার কথা ছিল, তা পাননি তিনি। বরং সন্ত্রাসীর মতো করে গ্রেপ্তার করা হয়।

মাওলানা সানাউল্লাহ বলেন, তাকে গ্রেপ্তারের কারণ জানতে চাইলে পুলিশ জানায়, কোনো কারণ নেই, ওপরের নির্দেশনায় গ্রেপ্তার করছি। তিনি বলেন, হাসিনার আমলের পুলিশ মসজিদ বলতে যে একটা সম্মানবোধ থাকে, জুতা খুলে প্রবেশ করতে হয়- সেটাও তারা করেনি। আসলে তারা বাংলাদেশের পুলিশ ছিল, নাকি অন্য কোনো রাষ্ট্রের লোক ছিল তা নিয়ে সন্দেহ হয়।

তিনি বলেন- আমাকে গ্রেপ্তারের দুটি কারণ থাকতে পারে। এক হলো, আমি খুব লেখালেখি করতাম। দ্বিতীয়ত, জুলুম-অত্যাচার, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে মসজিদে কথা বলেছি। নিউমার্কেটের মতো গুরুত্ব জায়গার খতিব হিসেবে টার্গেট করেই তারা আমাকে গ্রেপ্তার করেছে।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পেছনে আলেম-ওলামা নির্যাতনকে অন্যতম কারণ উল্লেখ করে মাওলানা সানাউল্লাহ বলেন- মসজিদের ইমাম পর্যন্ত নিরাপদ ছিলেন না। মসজিদগুলো কবজা করে সেখানে আল্লাহ ও রাসুলের কথা বন্ধ করতে চেয়েছিল।

কীভাবে নিজের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত এবং লুটপাট ও দুর্নীতি অব্যাহত রাখা যায়, ইমামরা যেন জুলুম-অত্যাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারে সেই কাজ করা হতো। তাদের এক ধরনের নির্দেশনা ছিল যে, মসজিদে মাটির ওপরের কথা বলবেন না, মাটির নিচের কথা তথা কবর-হাশর ইত্যাদি। অনেক ইমামকে সাধারণ সুদ-ঘুষের বিরুদ্ধে কথা বলায় অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

মাওলানা সানাউল্লাহ বলেন- মসজিদ থেকে গ্রেপ্তার করেই তাকে নেওয়া হয় পল্টন থানায়। সেখানে আরও কয়েকজন আলেম-ওলামা ছিলেন। সন্ত্রাস দমনের একটি মামলা দিয়ে পরদিন আদালতে তুলে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করানো হয়। রিমান্ডে পল্টন থানার ওসি আবু বকর আমাদের নির্যাতন দেখে কান্না করতেন।

উনি নিজের অপারগতা প্রকাশ করে বলতেন- সব অর্ডার আসে ওপরের ফ্যাসিস্ট দপ্তর থেকে। তিনি বলেন, অন্য সাধারণ বন্দিদের স্বাভাবিকভাবে আদালতে নেওয়া হলেও আমাদের হ্যান্ডকাফ ও ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ কখনও কখনও শারীরিক আক্রমণ করেছে। মানসিক আক্রমণ তো সব সময়ই চালাত।

তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশ থেকে এই নির্যাতন পরিচালিত হয়নি, র-এর এজেন্ট ও ভারতের কথায় আমাদের ওপর নির্যাতন হয়েছে। রিমান্ড শেষে কেরানীগঞ্জ কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। সেখানে ১৭-১৮ দিন ছিলেন তিনি। সেখানেও তাদের খাবার-দাবারে প্রচুর কষ্ট দেওয়া হয়েছে। রমজানে ঠিকমতো ইফতার করতে পারেননি তারা। কোনো ধরনের পানি খেয়ে সাহরি করেন। ইফতারেও পর্যাপ্ত খাবার পাননি।

তবে জেলের অন্য বন্দিরা তাদের দেখে কান্না করতেন। কারণ তাদের স্বাভাবিক স্থানে রাখা হতো না। জেলখানার ভেতরেও আরেকটা জেলখানা স্থাপন করা হয় নির্যাতনের জন্য। কেরানীগঞ্জ থেকে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে নিয়েও তাকে জঙ্গি সেলে রাখা হয়।

তিনি বলেন, জেলে তাদের হাঁটাচলার সুযোগ ছিল না। সব সময় রুমবন্দি করে রাখা হতো। সেখানে বিভিন্ন ধরনের কথার টর্চারিং ছিল। এভাবে ছয় মাস কারাজীবনে ব্যাপক কষ্টের মুখোমুখি হন তিনি।

হরতালের দিন বায়তুল মোকাররমে মিছিল করার হুকুমদাতা হিসেবে মামলা দেওয়া হয় মাওলানা সানাউল্লাহর বিরুদ্ধে। অথচ ওইদিন তিনি নিজের মসজিদে নামাজ পড়িয়েছেন। আদালতে বিষয়টি বলার চেষ্টা করা হলেও হেফাজতের মামলা হিসেবে ওঠানোর সুযোগ দেয়নি। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে প্রথমে হাইকোর্ট থেকে ও পরে নিম্ন আদালত থেকে জামিন পান তিনি। তবে মামলা এখনও চলমান আছে। এগুলো অব্যাহতি দেওয়ার জন্য হেফাজতের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে যোগাযোগ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, জামিনে মুক্তির পর সাধারণ মানুষের চাওয়া অনুযায়ী মসজিদের চাকরি ঠিক ছিল। তবে পরে আমি স্বাভাবিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। সেখানে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের তৎপরতায় মসজিদ কমিটি বিরক্ত হয়ে যায়, আমাকে রাখা নিয়ে বিভক্তিও দেখা দেয়। একপর্যায়ে তিনি নিজেই মসজিদের চাকরি ছেড়ে দেন। বর্তমানে মাদরাসা পরিচালনায় আছেন তিনি।

নিউমার্কেট মাদরাতুন নাজাতের প্রিন্সিপাল মাওলানা সানাউল্লাহ খান বলেন, মাদরাসাতেও গোয়েন্দা নজরদারি ছিল। তারপরও আমাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছিলাম। যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের আবার গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়া হতো। এবার ধরলে ফাঁসিতে ঝোলানোরও হুমকি দেওয়া হয়। এসব উপেক্ষা করেই আলেমরা তাদের কাজ অব্যাহত রাখে। তারই ধারাবাহিকতায় জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয়েছে।

গ্রেপ্তারের পর তার পরিবারও নিরাপদ ছিল না। এ প্রসঙ্গে সানাউল্লাহ খান বলেন, পটুয়াখালীতে তার বৃদ্ধ দাদা-দাদিকে হয়রানি করা হয়েছে। নাতির বিষয়েও তাদের বিষয়ে নানা খোঁজখবর নেয় পুলিশ। তারা পাকিস্তানপন্থি কি না ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করত। একপর্যায়ে তারা সেই বাড়ি ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি চলে যান। কেরানীগঞ্জে তার মা নিজের ঘরে ঠিকমতো থাকতে পারেননি। এলাকার মানুষ দিয়ে তাদের হয়রানি করা হয়। পুলিশ গিয়ে হররানি করত। পরিবার পরিজন পর্যন্ত নিরাপদে থাকতে পারেনি।

আলেম-ওলামা ধরেই জঙ্গি ট্যাগ দেওয়া হতো বলে জানান ঢাকা মহানগর হেফাজতে ইসলামের নির্বাহী সদস্য ও লালবাগ জোনের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা সানাউল্লাহ। রিমান্ডেও বারবার এ বিষয়গুলো তুলে ধরা হতো। তারা বলত হেফাজতের এত সমাবেশের টাকা পান কোথা থেকে? আমরা বলতাম, আমাদের কোথাও লিঙ্ক নেই। ধর্মীয় জায়গা থেকে আমরা এসব কাজ করি। কিন্তু তারা জঙ্গি কানেকশনে জড়ানো ও পাকিস্তানের সঙ্গে যোগসূত্রতা প্রমাণে বারবার নির্যাতন করত।

মাওলানা সানাউল্লাহ বলেন, যারা মসজিদগুলো পরিচালনা করতেন, তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে বেশি। কারণ মসজিদগুলো আলেম-ওলামাই নিয়ন্ত্রণ করেন এবং সেখান থেকে জুমায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মেসেজ দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের বড় একটা আয়ত্তের জায়গা ছিল মসজিদ। বিভিন্ন খতিবের ওপর তাই নির্যাতন করা হয়। ৫ আগস্টের আগেও জুলাই-বিপ্লব নিয়ে কথা বলায় এক দিনেই অন্তত ১০০ খতিবের চাকরি গেছে। শহীদদের জন্য দোয়া করায় এই শাস্তি। অনেক খতিবকে হত্যা করা হয়েছে, গুম করা হয়েছে। জুলাই বিপ্লবেও ১১৭ জন আলেম ও ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন।

তিনি বলেন, বর্তমানে মসজিদগুলোয় মুক্ত ও স্বাধীনভাবে ধর্মের কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন তারা। এটা একা আত্মতৃপ্তির বিষয়। যারা আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল, অতিদ্রুত তাদের এ দেশের রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা উচিত। একই সঙ্গে আওয়ামী ফ্যাসিস্টের অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে যথাযথ শাস্তি প্রয়োগ করা উচিত। ফ্যাসিস্ট হাসিনা যে অপরাধ করেছে, তাতে তার কয়েকবার ফাঁসি হওয়া উচিত। তার সহযোগী ও হুকুমদাতাদেরও দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি দেওয়া উচিত। তাহলে এ দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসবে। ধর্মীয় স্বাধীনতাও ফিরে পাবে সবাই।

মূল রিপোর্ট : আমার দেশ