ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল :
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৪ সালে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের প্রবাসীদের মাধ্যমে বাংলাদেশ তিন লাখ ২৭ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা রেমিট্যান্স হিসেবে পেয়েছে, যা আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশি অবস্থান করছেন এবং শুধু সৌদি আরবে অবস্থান করছেন প্রায় ৭৫ লাখ বাংলাদেশি। প্রতিবছর আমাদের দেশ থেকে প্রায় ১৩ লাখ মানুষ বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছেন।
একটি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা আর দেশে ফিরে আসছেন না। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা উন্নত দেশগুলোতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মাধ্যমে বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু দেশের যোগ্যতাসম্পন্ন মেধাবী ব্যক্তিদের মেধা, উদ্ভাবনী সক্ষমতা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা প্রভৃতির দ্বারা উন্নত বিশ্ব উপকৃত হচ্ছে আর বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
আমরা যদি যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে দেশে রাখতে সক্ষম হতাম, তবে সন্দেহ নেই বাংলাদেশ উপকৃত হতো। দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত মিস্টার পার্ক ইয়ং সিক আমাদের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের ছাত্রদের উদ্দেশে দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে তথ্য উপস্থাপন করেন। দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেশটি আমেরিকায় বসবাসরত দক্ষিণ কোরিয়ার ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারসহ অন্য মেধাবী ব্যক্তিদের উচ্চ বেতন ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার মাধ্যমে নিজ দেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল এবং সেসব মেধাবী ব্যক্তিদের মেধা ও যোগ্যতা দক্ষিণ-কোরিয়ার উন্নয়নে সফলভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিল।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ, প্রবাসীদের বিনিয়োগ এবং বিশেষভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ একান্তভাবেই প্রয়োজন।
তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অনুধাবন করা যায় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন প্রভৃতি দেশের জন্য আমাদের দেশে অটোমোবাইল সেক্টর, ইলেকট্রিক্যাল সেক্টর, খেলনা তৈরির খাত, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, জাহাজ নির্মাণশিল্প প্রভৃতি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়বে যোগ্যতাসম্পন্ন ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের দেশের বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট, কুয়েটসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা ইঞ্জিনিয়ারদের একটি বিরাট অংশ উচ্চ বেতন ও উন্নত জীবনযাত্রার জন্য উন্নত দেশসমূহে চলে যাচ্ছেন।
আমাদের দেশের ইঞ্জিনিয়ারদের বেতন কাঠামো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক-ইয়ং-সিক মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। একটি জরিপ অনুযায়ী আমাদের দেশের তরুণ ও যুবক শ্রেণি, যাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫-এর মধ্যে, তাঁদের ৫৫ শতাংশ উন্নত দেশে চলে যেতে আগ্রহী।
আমরা অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মেধাবীদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে ব্যর্থ হচ্ছি। কর্মসংস্থানের অভাব এবং চাকরির ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, সুযোগ-সুবিধার অভাব, শিক্ষা ও দক্ষতার সমন্বয়ের অভাব, টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল গ্র্যাজুয়েটদের স্বল্প বেতন কাঠামো, পরিবারের সদস্যদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ইত্যাদি কারণে অনেকেই দেশ ছেড়ে উন্নত দেশে স্থানান্তরিত হতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
কর্মজীবনের সুযোগ-সুবিধা, উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা, নিশ্চিত ভবিষ্যৎ ইত্যাদি কারণে অনেকেই আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আগ্রহী। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকসহ পেশাদার জনবল আমাদের দেশের যথাযথ নিয়ম-নীতির অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিজ দেশে আত্মোন্নয়নে সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি কারণে বিদেশ যেতে আগ্রহী হয়ে থাকেন। পারিবারিক সিদ্ধান্ত এবং পেশাগত উন্নয়নের কারণে অনেকেই উন্নত দেশে বসবাস করাকে শ্রেয় মনে করেন। আমাদের দেশের মেধাবী জনগোষ্ঠীকে দেশে রাখার জন্য এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে মেধাবীদের মেধার সঠিক ও কার্যকরভাবে ব্যবহারের জন্য যথাযথ নীতির অভাব রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেকে বাধ্য হয়েই বিদেশমুখী হয়ে থাকেন।
আমাদের দেশে সামাজিক নিরাপত্তারও অভাব রয়েছে। শ্রম আইনের সঠিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আইন এমনভাবে প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যাতে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় এবং ভবিষ্যতে উন্নয়নের সুযোগ থাকে। আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কলেজগুলোতে অনার্স এবং মাস্টার্স প্রগ্রাম চালু রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান সম্ভাব্য চাকরির ক্ষেত্রগুলোতে প্রয়োগের সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং বেতনসহ চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদর আকৃষ্ট করে বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন।
দেশের আইটি সেক্টরের উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তাতা তৈরির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতি, স্বচ্ছতার অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ইত্যাদির কারণে দেশ ত্যাগ করতে অনেকে উৎসাহিত হন। সাম্প্রতিক একটি জরিপ অনুযায়ী, স্বল্প বেতনকাঠামো, সুযোগ-সুবিধার অভাব, নিরাপত্তাহীন জীবন, বেকারত্ব ইত্যাদি কারণ ব্রেইন ড্রেইন প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ ছাড়া দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, উদ্ভাবনী সক্ষমতার স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ, পরিবেশসংক্রান্ত বিষয়, তীব্র প্রতিযোগিতা, খাদ্যে ভেজাল, আইন ও আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা, পরিচ্ছন্ন পরিবেশের অভাব ইত্যাদি কারণে উচ্চশিক্ষিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা উন্নত বিশ্বে স্থায়ীভাবে বসবাসে আগ্রহ প্রকাশ করছেন বলে জরিপে উঠে এসেছে।
উচ্চশিক্ষিত মেধাবী জনগোষ্ঠীকে দেশে রাখার জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বেতনের পরিমাণ বৃদ্ধি, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি রোধ, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি, গবেষণার সুযোগ ও পরিধি বৃদ্ধি ইত্যাদি প্রয়োজন বলে জরিপে উঠে এসেছে। আমাদের দেশের মেধাবীরা উন্নত দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ইত্যাদি কাজে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে সক্ষম হচ্ছেন। আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠার জন্য প্রয়োজন দেশপ্রেম, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, আন্তরিকতা ও পরিকল্পনাসমূহের সমন্বয় ও সফল বাস্তবায়ন। আমরা যদি আমাদের মেধাবীদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদানসহ সার্বিক পরিস্থিতি উন্নত করে দেশে রাখতে সক্ষম হতে পারি এবং তাঁদের মেধা ও যোগ্যতা আমাদের জাতীয় উন্নয়নে কাজে লাগাতে সক্ষম হতে পারি এবং দেশকে সেবা প্রদানের মানসিকতায় যদি আমাদের মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনবল দেশেই থেকে যায়, তবে নিঃসন্দেহে তা বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখবে। আমাদের মেধাবীদের দেশে রাখার জন্য সার্বিক পরিকল্পনা ও এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে পরিকল্পনাগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন ও সমন্বয় একান্তভাবেই কাম্য।
লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
ইমেইল : [email protected]