- সেবা পাচ্ছেন না হাজিরা
কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :
বছরের অন্য সময়ের লোকসান কাটাতে হজ মৌসুমকে ব্যবহার করছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এই সময়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া রাখছে তারা। হজ ফ্লাইটের লাভের টাকা দিয়ে বিমানে হজ বোনাস দেওয়া হলেও প্রাপ্য সেবা পাচ্ছেন না হাজিরা। ফ্লাইটে উঠা থেকে শুরু করে দেশে ফেরা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের নানা বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। এর জন্য সরকারি কোনো মনিটরিং সেল না থাকাকে দায়ী করছেন ভুক্তিভোগিরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান- হজচুক্তি অনুযায়ী সবার কাছ থেকে একই বিমান ভাড়া রাখা হলেও সবার ভাগ্যে জুটছে না ডেডিকেটেড ফ্লাইট। চার আসনের ভাড়া দিয়েও শতকরা ৫০ ভাগ হাজিকে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে শিডিউল ফ্লাইটে।
চলতি বছর ১ লাখ ২৭ হাজার হজযাত্রীর কোটা থাকলেও ৮৭ হাজার ১০০ জন রেজিস্ট্রেশন করেছে। এবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের হজ ফ্লাইটের ভাড়া যাত্রীপ্রতি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮২০ টাকা, যা ঢাকা-জেদ্দা রুটের নিয়মিত ফ্লাইটের ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি। বছরের অন্য সময়ে এই একই রুটে সময় ভেদে ভাড়া থাকে যাত্রীপ্রতি ওয়ানওয়ে ৪০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা।
হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) প্রতিনিধিরা মনে করেন, হজযাত্রীদের জন্য বেঁধে দেওয়া এই ভাড়া অনেক বেশি। তবে প্রায় প্রতি বছরই যাত্রীদের জন্য টিকিটের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে আহ্বান জানিয়ে আসছেন তারা। সূত্র জানায়, হজের খরচের বড় একটি অংশ ব্যয় হয় ফ্লাইটের টিকিটের জন্য। দেশে হজ ফ্লাইটের টিকিটের মূল্য নির্ধারণ হয় রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের প্রস্তাবিত ভাড়ার ভিত্তিতে। হজের চুক্তির সময় হজ যাত্রীদের শতভাগ ডেডিকেটেড ফ্লাইটে পরিবহনের কথা উল্লেখ থাকলেও তাদের অর্ধেক পরিবহন করা হয় ডেডিকেটেড ফ্লাইটে বাকি অর্ধেক পাঠানো হয় শিডিউল ফ্লাইটে। ফলে যাত্রীপ্রতি ভাড়ার ক্ষেত্রে হচ্ছে তারতম্য। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী, সবার কাছ থেকে একই পরিমাণ টাকা নেওয়া হচ্ছে। বিমানের পাশাপাশি সাউদিয়া এয়ারলাইনসও একইভাবে হজযাত্রী পরিবহন করে থাকে।
হজচুক্তি অনুযায়ী, প্রতি বছরই মোট হজযাত্রীর অর্ধেক পরিবহন করে বিমান, বাকি অর্ধেক পরিবহন করে সাউদিয়া এয়ারলাইন্স।
একজন পাইলট জানান, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস গত বছর হজ ফ্লাইট পরিচালনা করে মুনাফা করেছে ১৯ কোটি টাকা। প্রতি বছরই বিমানের ক্লিনার থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রত্যেকেই হজ বোনাস পেয়ে থাকেন। হজ পোস্টিংয়ের নামে হজের সময় বিমানের একটা বিশাল গোষ্ঠী সৌদি আরব গিয়ে কাজের নামে ঘুরে বেড়ায়। অনেকে জেদ্দা বিমানবন্দরের ভেতরের পাসও পায় না। এতে বিমানের অহেতুক টাকা খরচ হয়। এ সব খাত থেকে টাকা সাশ্রয় করে বিমান চাইলে হজ যাত্রীদের টিকিটের দাম কমাতে পারে। এতে হাজিরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই পাইলট বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ গরিব । তারা সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে শেষ বয়সে হজে যান। ধর্ম মন্ত্রণালয় ও বিমান চাইলে হজ প্যাকেজের সময় কমিয়ে এনে ব্যয় কমাতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিমানকে হজ ফ্লাইট বাড়াতে হবে। এতে লাভবান হবেন হাজিরা।’
হাবের সাবেক সভাপতি ফরিদ আহমেদ মজুমদার বলেন, টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়, সেটি অনুমোদন করে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। আমরা মনে করি, যৌক্তিক ভাড়া নির্ধারণ হওয়া উচিত। এ জন্য অ্যাভিয়েশন খাতের বিষয়ে যারা বোঝেন, তাদের সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করতে পারে সরকার। এই কমিটি সব ধরনের খরচ, সবকিছু বিবেচনা করে ভাড়া নির্ধারণ করবে। বিমান এককভাবে কোনো প্রস্তাব করলে; সেটির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত না নিয়ে কমিটির প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভাড়া নির্ধারণ হবে। কখনো কখনো লিটারে ১০ থেকে ২০ সেন্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়ে। কিন্তু বিমান এই অজুহাত দেখিয়ে জনপ্রতি ভাড়া ২০-৩০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ফেলে। বিমান বলে ডেডিকেটেডে ফ্লাইটের ফিরতি ফ্লাইটটা খালি আসে এতে কোনো যাত্রী পরিবহন করা হয় না। কিন্তু উড়োজাহাজ খালি আসায় জ্বালানি খরচ কমে যায়, কার্গো, ক্যাটারিং কোনো খরচই থাকে না। তাহলে আর খরচ কত লাগে?
ফরিদ আহমেদ মজুমদার বলেন, ‘বিমানের একচেটিয়া ভাড়া নির্ধারণের প্রবণতা রোধে হাব বরাবরই হজ যাত্রীদের খরচের বোঝা কমাতে তৎপর ছিল। অনেক আগে থেকেই আমাদের দাবি ছিল, দুটি এয়ারলাইনসের পরিবর্তে অন্য এয়ারলাইনসে হজযাত্রী পরিবহনের সুযোগ রাখা হোক। তাহলে একচেটিয়া ভাড়ার পরিবর্তে প্রতিযোগিতামূলক ভাড়া নির্ধারণ হবে।’
হাব নেতারা জানান, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ হজ যাত্রীদের জন্য ভর্তুকি দেয়। এ কারণে সেসব দেশের হজের খরচ তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। ভারতও হজ যাত্রীদের জন্য ভর্তুকি দিত। তবে ২০১৮ সালে ভারত সরকার সেটি প্রত্যাহার করে নেয়। তারপরেও একজন ভারতীয় নাগরিক একজন বাংলাদেশি নাগরিকের তুলনায় অনেক কম খরচে হজ সম্পন্ন করতে পারেন। বাংলাদেশ চাইলে হজযাত্রীদের টিকিটের ওপর ভর্তুকি দিতে পারে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ বলেন, এই মুহূর্তে সৌদি আরবে আসা-যাওয়ার খরচ এয়ারলাইন্স-ভেদে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা বলে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বলছে- বছরের অন্য সময়ে ওমরাহ পালন বা অন্য কোনো কারণে সৌদি আরবে ৭০-৮০ হাজার টাকার মধ্যেই রিটার্ন টিকিট পাওয়া যায়। যদিও মধ্যপ্রাচ্যগামী যাত্রীদের ভিড় বাড়লে অনেক সময় কিছু এয়ারলাইনস সেই সুযোগে হুট করে দাম অনেক বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এবার হজের খরচ কমবে। তিনি বলেন, আগামী বছরের হজ যাত্রীদের বিমান টিকিটের ওপর থেকে আবগারি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে যাত্রীর এম্বারকেশন ফি, নিরাপত্তা ফি ও এয়ারপোর্ট নিরাপত্তা ফির ওপর থেকে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। টিকিটের ওপর প্রযোজ্য শুল্ক ও ফি ও মূসক হ্রাস বা অব্যাহতি দেওয়ায় হজযাত্রীদের টাকা সাশ্রয় হবে।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম বলেন, ‘হজ ফ্লাইটের লাভের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। হাজিপ্রতি বিমানের খরচ কত হচ্ছে তা আমি বলতে পারব না।’
মূল রিপোর্ট : আমার দেশ