জানা গেলো ড. মোমেন কোথায় আছেন

কওমি কণ্ঠ রিপোর্টার :

গণঅভ্যুত্থানের মুখে চব্বিশের ৫ আগস্ট পতন হয় স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার। গণপিটুনি ও গ্রেফতারের ভয়ে এদিন থেকেই একে একে পালিয়ে যেতে থাকেন আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীসহ বড় থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা। পালান সিলেটের রাঘববোয়ালরাও। 

কে কোথায় কীভাবে পালিয়েছেন- এসব খবর বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেলেও আওয়ামী লীগ আমলের সিলেট-১ আসনের এমপি ও বিনাবভোটে পার্লামেন্টে যাওয়া সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের অবস্থানের বিষয়ে জানা গেলো নতুন তথ্য। 

আমার দেশ পত্রিকার খবর- ড. মোমেন আমেরিকায় অবস্থান করছেন। তিনি ২ আগস্ট দেশ ছাড়েন।

সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৫ আগস্ট পরবর্তী দায়েরকৃত বেশ কয়েকটি নাশকতা ও হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। মৌলভীবাজারেও তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে।

খবরে প্রকাশ- গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির শীর্ষ নেতাদের দেশ ছাড়ার হিড়িক পড়ে। এর মধ্যে ১৬ এমপি আমেরিকায় পালিয়ে গেছেন। পলাতকদের ফেরাতে পুলিশ ইন্টারপোলের সহযোগিতা নেবে বলে জানিয়েছে। ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, দুর্নীতি ও হত্যামামলায় অভিযুক্ত এসব নেতা বিদেশে থেকেও ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

ইমিগ্রেশন সূত্র জানিয়েছে, পলাতকদের মধ্যে ১৬ এমপি আমেরিকায় গেছেন। তাদের কেউ কেউ ৫ আগস্টের পর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য কান্টনমেন্টে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

পরে তারা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আমেরিকায় যান। এসব এমপির বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকা এবং হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে। আবার কারো বিরুদ্ধে দুদক মামলা দায়ের করেছে। এসব মামলায় কারো কারো বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও রয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি শাখা পলাতক এমপিসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের তালিকা করছে। তালিকায় কোন এমপি ও মন্ত্রী কোন সময় দেশ ছেড়েছেন এবং কোন দেশে ও কোথায় অবস্থান করছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তারা কী ভূমিকা পালন করেছেন এবং তাদের নামে কোন থানায় কতটি মামলা রয়েছে— এসব বিষয় হালনাগাদ করা হচ্ছে। ইন্টারপোলে তথ্য দিয়ে তাদের ফেরাতে একাধিক চিঠি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশে ফিরিয়ে তাদের আইনের মুখোমুখি করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

কারা সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন ৪২ সংসদ সদস্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইমিগ্রেশনের এক কর্মকর্তা জানান, যারা দেশ ছেড়েছেন, তাদের আগে থেকেই আমেরিকার ভিসা ছিল। তাদের অধিকাংশই ৫ আগস্টের আগেই চলে গেছেন। তবে শুধু তিনজন এমপি গেছেন ৫ আগস্টের পর।

আওয়ামী লীগ এমপিদের পলায়ন ও বিদেশে বসে তাদের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ডিআইজি বলেন- শুধু এমপি-মন্ত্রী নয়, যারাই আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পালিয়েছেন, তাদের ফেরাতে পুলিশ কাজ শুরু করেছে। তাদের অপতৎপরতা সম্পর্কে পুলিশ সজাগ আছে। তাদের দেশে ফেরাতে পুলিশ কাজ করছে। দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

উল্লেখ্য, ন্যাপের রাজনীতি করে বেড়ে উঠা সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগের এমপি ড. আব্দল মোমেন বড় ভাই সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের আশির্বাই হন এমপি, পরে হন মন্ত্রী। ৫ আগস্টের পর বেরিয়ে আসে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর বিষয়ে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, ড. মোমেন মন্ত্রী হলেও সর্বময় ক্ষমতার মালিক ছিলেন তাঁর স্ত্রী সেলিনা মোমেন। স্বামীকে মন্ত্রী নয়, যেনো আলাদিনের চেরাগের দৈত্য হিসেবে পেয়ে যান সেলিনা। রাতারাতি শতকোটি টাকার মালিক হয়ে যান রহস্যময়ী এই নারী। 

ক্ষমতার দাপটে সেলিনা সিলেট-১ আসনের টিআর,কাবিখা থেকে শুরু করে সকল প্রজেক্টের ২৫% কমিশনের মালিক হন। টাকাগুলো সহজে হজম করতে গড়ে তুলেন সেলিনা-মোমেন ফাউন্ডেশন। সদর উপজেলার সবগুলো প্রকল্প যার হাত দিয়ে বাস্তবায়িত হয় সেই প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন অফিসার বা পিআইও পদে তিনি নিয়ে আসেন হিরন মাহমুদকে। হিরনের বাড়ি সেলিনার নিজ জেলা কুমিল্লায়।

পোস্টিং দেয়ার আগে হিরনকে ঢাকায় ডেকে নিয়ে ৩ দিন রাখেন সেলিনা। কীভাবে সরকারি সমস্ত বরাদ্দের একটি অংশ তিনি পেতে পারেন সেই কলাকৌশলের একটি ছক হিরনকে নিয়ে তৈরি করেন। ছক বাস্তবায়নের জন্য মিশনে যুক্ত করা হয় আরো দুজনকে। তারা হলেন- তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের এপিএস শফিউল আলম জুয়েল এবং বিতর্কিত মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সিলেট মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পলাতক হেলেন আহমেদকে। এই হেলেন আহমদ সিলেটে একজন ভূমিদস্যু হিসাবে পরিচিত। প্রতিটি সরকারি প্রকল্পের কাজ দেয়ার সময় ঠিকাদারকে শর্ত দেয়া হতো চেক নেয়ার সময় বিলের ২৫ শতাংশ ম্যাডামের জন্য নগদে পরিশোধ করতে হবে। এই শর্তে যারা রাজি হতেন তারাই কাজের ঠিকাদারি পেতেন। এই ২৫ শতাংশের টাকা নগদে গ্রহণ করতেন পিআইও হিরন মাহমুদ। হিরন মাহমুদের কাছ থেকে হিসেব বুঝে নিয়ে সেলিনার কাছে পৌঁছে দিতেন জুয়েল ও হেলেন আহমদ। কাজের আগেই বাধ্য হয়ে বিলের ২৫ শতাংশ ‘ম্যাডাম’র জন্য নগদে আগাম পরিশোধ করতে হতো।

পরে নিম্নমানের কাজ আর প্রকল্প অসমাপ্ত রেখেই তা পুষিয়ে নিতে হতো ঠিকাদারকে। যেহেতু পিআইও নিজে এসব দুর্নীতির সাথে জড়িত, তাই প্রকল্প না করলেও থেমন সমস্যা হতো না। এছাড়া, গত ৬ বছরে টিআর-কাবিখার হাজার হাজার ভূয়া প্রকল্প তৈরি করে সমুদয় টাকা আত্মসাত করে এই সেলিনা সিন্ডিকেট।

অভিযোগ রয়েছে- পিআইও হিরন মাহমুদ প্রকল্পের কাগজপত্র তৈরি এবং তা বাস্তবায়নের রিপোর্ট দিয়ে টাকা উত্তোলন করতেন। সেই টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা হতো সেলিনা, জুয়েল, হিরন মাহমুদ এবং হেলেনের মধ্যে। সেলিনার নির্দেশে এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুমোদন দিয়ে গেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। শুরুতে কিছুটা প্রতিবাদ করতে গিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ পড়েছিলেন তোপের মুখে। পরে তিনিও নিরবে তা অনুমোদন করে গেছেন।

স্বামীর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি ছিলো সেলিনা মোমেনের কাছে টাকার গাছ। টানা পাঁচ বছর সে গাছ থেকে ইচ্ছেমত টাকা পেড়ে বিদেশে পাচার করেছেন সেলিনা। টাকা পাচারের অন্যতম সুযোগ ছিলো বিদেশে রাষ্ট্রীয় সফর। প্রতিমাসে মন্ত্রীর অন্তত একটি বিদেশ সফর থাকতো। আর প্রতিটি সফরে মন্ত্রীর অপরিহার্য সফরসঙ্গী থাকতেন স্ত্রী সেলিনা মোমেন। মন্ত্রীর সফরসঙ্গীর নামে প্রতিটি সফরে ৮/১০ জনকে সাথে করে নিয়ে যেতেন সেলিনা। তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১০/১৫ লাখ টাকা করে আদায় করতেন। মন্ত্রণালয়ের প্যাডে বিশেষ রিকুয়েস্ট লেটার ইস্যু করে তাদের ভিসা করিয়ে নিতেন সহজে। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মন্ত্রী মোমেনের বেশ কয়েকবার বাক-বিতন্ডা হয়। আদমপাচারের বানিজ্যে খদ্দের যোগাড় করে দিতেন মন্ত্রীর এপিএস জুয়েল, বিতর্কিত মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী হেলেন এবং সদর উপজেলার মোগলগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিরন মিয়া। মন্ত্রণালয়ের রিকুয়েষ্ট লেটারে ভিসা করালেও বিতর্ক এড়াতে তাদেরকে সাথে না নিয়ে ভিন্ন ফ্লাইটে বিদেশ পাঠাতেন মোমেন-সেলিনা। মোমেন বাহিরে ছিলেন সাচ্চা মানুষ। নিজে সরাসরি দুর্নীতি না করলেও ঘুরিয়ে ঠিকই টাকার-সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ঘুষ-কমিশন সবই খেয়েছেন। কমিশন আর ঘুষের টাকায় তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হয়েছে রিষ্টপুষ্ট।

অভিযোগ আছে- মোমেনের স্ত্রী সেলিনা মোমেন সিলেট পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রতি মাসে ৩০ লক্ষাধিক টাকা কমিশন নিতেন। পাসপোর্ট অফিসের টোকেন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন সোর্সকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতির যে রাজত্ব তৈরি করা হয়েছিল তার হিসাব প্রতি মাসে নিতেন সেলিনা।

এছাড়া চোরাচালানির রুট হিসেবে ব্যবহারের জন্য সিলেট এয়ারপোর্ট থেকেও আসত একটি অংশ। সবসময় তাকে রাজি ও খুশি রাখতেন সিলেট এয়ারপোর্টের কর্তারা। সিলেট এয়ারপোর্ট থেকে কোম্পানিগঞ্জ রাস্তায় ৫৬০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ উঠে একাধিক সূত্র থেকে। আর এই কাজটি করেছেন মোমেন ও তার স্ত্রী দুজনে মিলেই। নিজের স্বামীর হয়ে সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন জেলা প্রশাসক রাসেল হাসান ও জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুনের মাধ্যমে ৩ কোটি টাকা অবৈধ লেনদেন করেন সেলিনা মোমেন। সিলেট সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন বরাদ্দ আনতে হতো তাকে ছুঁয়ে। সব কাজেরই কমিশন পেতেন তিনি। এমনকি চিনি চোরাচালান থেকেও তাকে মাসে একটি ভাগ দেওয়া হতো। যা বণ্টন করতেন সাবেক জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন নিজেই। তিনিই ড. মোমেনের ভাগ তার কাছে পৌঁছে দিতেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর ঢাকা-সিলেট চারলেন প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দিতে চায়না কোম্পানির কাছ থেকে ১৫০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এ.কে আব্দুল মোমেন। কার্টুন ভর্তি চায়ের প্যাকেটে করে মোমেনের বাসায় টাকাগুলো পাঠিয়েছিলো ঠিকাধারী প্রতিষ্টান ঐ চায়না কোম্পানি। সেই টাকার ভাগ না পেয়ে বেকে বসেন সড়ক সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। যে কারণে বছরের পর বছর আটকে থাকে বহুল আলোচিত প্রকল্পটি। এর আগে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোমেনের ঘুষ নেয়ার তথ্য ফাঁস করেছিলেন খোদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। তখন মোমেন প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়েছিলো ঘুষ নয় বরং লবিং চার্জ হিসেবে এ টাকা নিয়েছেন তিনি। বিনা ভোটের এই এমপি আর ভাইয়ের কোঠায় মন্ত্রী মোমেন পাঁচ বছরে দেশ কিংবা সিলেটের জন্য কিছু করতে না পারলেও তার স্ত্রী সেলিনা মোমেনকে শত শত কোটি টাকার মালিক বানিয়েছেন। জুলাই বিপ্লবের আগে সেলিনা আমেরিকায় পালিয়ে গেছেন।