সরকারি ওয়েবসাইটে এখনো ফ্যাসিবাদের বয়ান!

কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :

পতনের আট মাস পার হলেও বিভিন্ন সেক্টরে ফ্যাসিবাদের শিকড় আঁকড়ে রয়েছে। সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহাল রয়েছে আওয়ামী বয়ান। বাদ যায়নি সরকারি ওয়েবসাইটগুলোও। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের ওয়েবসাইটে এখনো শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনাসহ বিগত সরকারের ‘অমূলক গুণকীর্তন’ দেখা যাচ্ছে। সরকারের বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের ওয়েব পোর্টাল যাচাই করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে সাবেক সরকারের পক্ষের বয়ান না থাকলেও তা রয়েছে দেখা গেছে প্রধান ‍উপদেষ্টার অধীন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এখনো শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে। শেখ মুজিবকে ‘স্বাধীনতার মহান স্থপতি’, ‘জাতির পিতা’ ও ‘বাঙালির প্রাণপুরুষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

অপরদিকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে আওয়ামী কায়দায় উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ‘বঙ্গবন্ধুর’ পক্ষে স্বাধীনতার আরেকটি ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটের গ্যালারিতে ২০২৩ সালের ১৫ আগস্ট ‘জাতীয় শোক দিবস’-এ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সচিবের নেতৃত্বে মুজিবের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের ছবি শোভা পাচ্ছে। একই বছর ‘শেখ রাসেল দিবস’ পালনের ছবিও ওয়েবসাইটে আপলোড অবস্থায় আছে। শেখ মুজিবের ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ পাওয়ার ৫০ বছরপূর্তি পালনের বেশ কয়েকটি ছবিও রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ফটো গ্যালারিতে। ওই ছবিগুলোয় শেখ হাসিনার উপস্থিতি রয়েছে।

অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে ওয়েবসাইটে ইতিহাস ও কার্যাবলিসংক্রান্ত তথ্য সরাসরি আপলোড করা হলেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এটাকে ডিপিএফ ফাইল আকারে যুক্ত করা হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সবগুলো আন্দোলনে শেখ মুজিবকে বিশেষভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা মামলা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে শেখ মুজিবকে ‘বাঙালির প্রাণপুরুষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

’৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন অংশে মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘৭ মার্চের এই ভাষণ কোনো দলীয় নেতার নির্দেশ ছিল না। ছিল একজন জাতীয় নেতার নির্দেশ।’ এতে আরো বলা হয়, ‘সেনাবাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু রাত ১২টা ৩০ মিনিটে (২৫ মার্চ ১৯৭১ দিবাগত) ধানমন্ডির বাসভবন থেকে বন্দি হওয়ার আগে তিনি দলীয় নেতাদের করণীয় বিষয়ে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে অবস্থান পরিবর্তনের কথা বলেন। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়।’

পিডিএফটিতে বলা হয়, ‘‘চট্টগ্রামে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে (শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা) প্রচারের জন্য পাঠানো হয়। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ঘোষণাকে অবলম্বন করে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা এমএ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ২৭ মার্চ অপরাহ্নে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার আরেকটি ঘোষণা পাঠ করেন। এই ঘোষণায় তিনি (জিয়াউর রহমান) উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে।’

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ওয়েবসাইটের ইতিহাস ও কার্যাবলিতে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের পর স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজ-কালভার্ট পুনর্গঠন ও দেশব্যাপী যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নের কার্যক্রম হাতে নেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রাখেন। জাতির পিতার সুদৃঢ় নেতৃত্বে ওই সময়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে বিধ্বস্ত প্রায় সব ব্রিজ পুনর্নির্মাণ করা হয়। …. সার্বিক যোগাযোগব্যবস্থায় গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১১ সালে পৃথক রেলপথ বিভাগ, সেতু বিভাগ এবং সড়ক বিভাগ সৃষ্টি করা হয়।’

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ওয়েবসাইটে উল্লেখ রয়েছে, ‘‘স্বাধীন বাংলাদেশে ডাক ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকীকরণের মূল সূচনাকারী ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’।”

অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের ওয়েবসাইটে ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের কথা বলা হয়েছে। জনপ্রশাসন এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও একই ধরনের তথ্য আপলোড রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন দূতাবাসে বিগত বছরগুলোয় শোক দিবস পালনের ছবি শোভা যাচ্ছে। জানা গেছে, এই মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে শেখ হাসিনার পক্ষের বিভিন্ন তথ্য আপলোড থাকলেও অতিসম্প্রতি সেটা আনপাবলিশ করে রাখা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেখ হাসিনার পতনের পর ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশকিছু মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, বিভাগীয় কার্যালয়, জেলা ও উপজেলাপর্যায়ের সরকারি ওয়েব পোর্টাল থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পক্ষে অতিরঞ্জিত করে প্রচারিত তথ্য অপসারণ করে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কিত সঠিক তথ্য আপলোড করা হয়। কিন্তু সরকারি দপ্তর শেখ হাসিনার আমলের তথ্য না সরিয়ে আনপাবলিশ করে রেখেছে। আর বাকিগুলোতে এখনো শেখ হাসিনার নানা কর্মসূচি, পদক্ষেপের তথ্য ও স্থিরচিত্র ও ভিডিও এখনো অব্যাহত রয়েছে।

মূল রিপোর্ট : আমার দেশ