কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :
গ্রামের মানুষদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করার নামে সুদের টাকা আদায় ও বিনিময়ে জমি দখল কিংবা ব্ল্যাঙ্ক চেক হাতিয়ে নেওয়ার মতো জঘন্য সব কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন রুহেল আহমদ। এমনকি স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত নেতা-কর্মীদের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে মাসিক মাসোহারাও গ্রহণ করতেন তিনি। কারো কারো কাছে বড় অঙ্কের চাঁদাও দাবি করতেন। কেউ নগদ অর্থ চাঁদা দিতে অপারগ হলে তার কাছ থেকে নির্ধারিত তারিখ বসিয়ে ব্ল্যাঙ্ক চেক লিখে নিতেন। সময় অতিবাহিত হলে চেক ডিজওনার করে মামলার মাধ্যমে চারগুণ টাকা আদায়ের ভয় দেখিয়ে অবৈধভাবে জমি দখল কিংবা মাসিক কিস্তিহারে সেই চাঁদা আয় করে নিতেন এই আওয়ামী ডেভিল।
অভিযুক্ত রুহেল আহমদ সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ০৪ লক্ষীপাশা ইউনিয়নের ০৫নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক।
জানা যায়, গত বছরের ৪ আগস্ট গোলাপগঞ্জে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরাসরি হামলা করে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগ। এই হামলায় অংশ নেয় রুহেল মেম্বার। ওইদিন তাদের গুলিতে অন্তত ৭ জন নিহত হন। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের পরিবার। এমন ৩টি মামলার এজাহার নামীয় আসামি এই রুহেল মেম্বার। এসব মামলার প্রেক্ষিতে গত সোমবার (১৯ মে) বিকেল সাড়ে ৫টায় হেতিমগঞ্জ বাজারে তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে স্থানীয় জনতা। পরদিন আদালতের মাধ্যমে তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করে গোলাপগঞ্জ থানা পুলিশ।
গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গোলাপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মোল্যা।
এদিকে গ্রেফতারের পর এক এক করে রুহেলের সব কুকীর্তি জনসম্মুখে আসতে থাকে। ভুক্তভোগীরা তার দ্বারা হয়রানীর এসব বিষয় গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেন।
স্থানীয় যুবদল নেতা ও হেতিমগঞ্জ বাজার বণিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল খয়ের চৌধুরী জানান, ‘আওয়ামী লীগ নেতা রুহেল মেম্বার ২০১৭ সালে আমাকে মিথ্যে মামলার ভয় দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও কয়েকটি স্বাক্ষরকৃত ব্ল্যাঙ্ক চেক হাতিয়ে নেয়। পরবর্তীতে চেক ডিজওনারের মাধ্যমে মামলা দায়ের করে চারগুণ অর্থ আদায়ের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতো। টাকা দিতে না পারায় আমাকে ও আমার পরিবারকে মিথ্যা মামলায় জেল জুলুম ও হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘রুহেলের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ন্যায় বিচার পেতে আইনের আশ্রয় নেই। ছোট ভাই সুমন আহমদ চৌধুরীকে বাদী করে অতিরিক্ত চীফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, সিলেটে একটি মামলা (সিআর১২৯/২০২১) দায়ের করি। বিজ্ঞ আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে পিবিআইকে তদন্তভার দেন। সেই তদন্তে রুহেলের দাখিলকৃত যাবতীয় ডকুমেন্ট ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়। পরবর্তীতে চাপ প্রয়োগ করে মামলাটি আপোষে নিষ্পত্তি করতে বাধ্য করে রুহেল।’
সুমন আহমদ চৌধুরী জানান, ‘মামলার ঘটনার পর আমাদের উপর আরও ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে ওই ডেভিল। এর মধ্যে আমার ভাই আবুল খয়ের চৌধুরী প্রবাসে চলে গেলে আমাকে বিভিন্নভাবে হয়রানী শরু করে। মিথ্যা মামলা ও পুলিশকে দিয়ে ভয় দেখিয়ে আমার কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। এখন তার গ্রেফতারে আমি খুশি। আদালত যেনো তার সুষ্ঠু বিচার করেন।’
রুহেল মেম্বারের বিভিন্ন কুকীর্তি তুলে ধরে স্থানীয়রা জানান, রুহেল মেম্বার প্রথমে এলাকার কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে নির্দিষ্ট মেয়াদে নিঃস্বার্থ শর্তে ব্যবসার জন্য নগদ অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। ব্যবসায় মূলধন খাটিয়ে নির্ধারিত তারিখে তার টাকা ফেরত দিলেই চলবে এমনটি জানান। কিন্তু সময়মতো টাকা ফেরত দিতে গেলে তিনি সুদের টাকা দাবি করেন। শুধুই সুদ নয়, এ যেনো মূলধনের তিনগুণ। তখন ব্যবসায়ীরা অপারগতা জানালে তিনি জমি দখলের মতো জঘন্য কাজ করেন। তার এমন অপকর্মে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি।
ভুক্তভোগীদের অনেকেই বলেন, রুহেল মেম্বার আমাদের থেকে সুদের টাকার বিনিময়ে ব্ল্যাঙ্ক চেক নিতেন। চেক না দিলে তিনি মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জেল খাটানোর হুমকি দিতেন। কখনো কখনো আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা ও পুলিশ দিয়ে হুমকি দেওয়াতেন। যার জন্য ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে পারিনি।
তারা বলেন, রুহেল মেম্বার আওয়ামী লীগ নেতা। থানা পুলিশের সাথে তার সখ্যতা ছিল। তার বাড়িতে পুলিশের অবাধ বিচরণ ছিল। গ্রামের বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের গ্রেফতারে পুলিশ তার বাড়িতেই অবস্থান করতো। সেখানে খোশ গল্পের পর তারা অভিযানে নামতো। দেখলে মনে হতো, এটি একটি পুলিশ ক্যাম্প। বিট পুলিশ ও আওয়ামী নেতাদের শেল্টারে তিনি এলাকায় বড় ধরণের মাদক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন। ছাত্রলীগ কর্মীরাই ছিল এসব মাদকের সরবরাহকারী। গ্রামসহ হেতিমগঞ্জ বাজারের বিভিন্ন স্পটে এসব মাদক বিক্রয় করা হতো। ফ্যাসিবাদী সরকার এখনও ক্ষমতায় থাকলে এলাকার প্রতি ঘরে একজন করে মাদকসেবী গড়ে উঠতো।
জনশ্রুতি রয়েছে, এলাকায় কেউ মারা গেলে সেই মৃত ব্যক্তির পরিবারের কাছে টাকা চাইতেন রুহেল। মৃতের নিকট তিনি বড় অঙ্কের টাকা পাওনা দাবি করে ওই পরিবারকে ঋণ পরিশোধের চাপ দিতেন। এলাকার প্রত্যেকটি মৃতের পরিবার এমন ঘটনার সাক্ষী।
এদিকে, রুহেল মেম্বারের গ্রেফতার ও হাজত বাসের জন্য উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন হয়রানীর শিকার জনতা। তারা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেন।