পাথরের পর এবার খেকোদের চোখ বালুর দিকে

কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :

সিলেটের সীমান্তবর্তী খনিজসম্পদের হরিলুট কোনোভাবেই যেন থামানো যাচ্ছে না। ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর, পর্যটন এলাকা জাফলংয়ের পাথর লুটপাটের পর এখন বালুমহালে থাবা খনিজসম্পদখেকোদের। বৈধ-অবৈধ সব মহাল থেকে প্রতি মাসে লুট হচ্ছে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার বালু। তবে সুনির্দিষ্ট হিসাব কোনো সংস্থার কাছেই নেই।

সূত্র জানায়, পথে পথে চাঁদা দিয়ে লুটপাটকৃত বালু এখন অবাধে পাচার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সিলেটের বালু অত্যন্ত উন্নতমানের বলে দেশব্যাপী এর চাহিদা রয়েছে। নামসর্বস্ব ইজারা নিয়ে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ এখন অস্থায়ী প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ইজারাদারদের। চাঁদা আদায়ে অংশ নিয়েছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদও। প্রশাসন পাথর সামাল দিতে যখন হিমশিম খাচ্ছে, সে সুযোগে অবাধে বালু লুট হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্থানীয়রা বলছেন, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠা চক্র প্রকাশ্যে এই বালু লুট করছে। মাঝেমধ্যে প্রশাসন অভিযান চালালেও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পর্যটনকেন্দ্রগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ আমলেই সিলেটের বিভিন্ন পাথরকোয়ারি ও বালুমহাল লুটপাট হয়েছে। প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের অনুগত লোকজন এসব নিয়ন্ত্রণ করায় সাধারণ মানুষ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেনি। সাবেক প্রবাসী ও বৈদেশিক কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদের আশীর্বাদপুষ্ট কোম্পানীগঞ্জের শামীম আহমদ (পাথরখেকো শামীম) এবং গোয়াইনঘাটের কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার নিয়ন্ত্রণে ছিল লুটপাট সিন্ডিকেট।

২০১৩ সালে পাথরকোয়ারি হিসেবে গেজেটভুক্তও করা হয় শ্রীপুরকে। এতে ধীরে ধীরে শ্রীপুর থেকে বালু উত্তোলনের ফলে অপরূপ সুন্দর শ্রীপুরের শ্রীহানি ঘটে। এর প্রভাব পড়ে রাংপানি নদীতেও।

সূত্র জানায়, ২০২০ সাল থেকে এখানে ইজারা বন্ধ আছে। তবে অবৈধভাবে শ্রীপুরে বালু-পাথর লুটপাট ঠিকই চলত। একই চিত্র ছিল পর্যটনকেন্দ্র রাংপানিতেও। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। আগে যেখানে আড়ালে-আবডালে লুট চলত, সেটা এখন প্রকাশ্যে চলছে।

চার দশক আগে সিনেমায় দেখা শ্রীপুর ও রাংপানির সঙ্গে এখনকার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বড় বড় পাথরের অধিকাংশই এখন লুট হয়ে গেছে। অবশিষ্ট যা আছে, তা-ও দেদার লুট হচ্ছে। আগেকার টিলাসদৃশ বালুর স্তূপও এখন আর নেই। নদী ও আশপাশের চরে থাকা বালু বেলচা-কোদাল দিয়ে খুঁড়ে নেওয়া হচ্ছে। পাচার করা হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ ঘনফুট ধারণ ক্ষমতার বাল্কহেড (পণ্যবাহী মাঝারি জাহাজ) দিয়ে নদীপথে। এতে দুটি এলাকাই হয়ে পড়েছে শ্রীহীন। একসময়ের সৌন্দর্যের জনপদ এখন অনেকটাই বিরানভূমি।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, শ্রীপুর, রাংপানি ছাড়াও ইজারাভুক্ত নয়Ñএমন মহাল থেকে বালু লুটে নেওয়া হচ্ছে। ইজারাদার অনেকের বিরুদ্ধেও ইজারাবহির্ভূত জায়গা থেকে বালু তোলার অভিযোগ আছে।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সিলেটে বালুমহাল আছে ৪০টি। এর মধ্যে ইজারাযোগ্য ২০টি। প্রায় ২৭ কোটি ১৫ লাখ টাকায় ১৫টি বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে। পাঁচটি এখনো ইজারা হয়নি।

নির্বিচারে বালু লুট, পথে পথে চাঁদা :
গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত কেবল জাফলং-গোয়াইনঘাটের হাজীপুর এলাকাতেই অন্তত ২০ কোটি টাকার বালু লুট হয়েছে। পথে পথে চার ধাপে চাঁদা দিয়ে এসব বালু বোঝাই বাল্কহেড চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

স্থানীয় লোক ও পাথর পরিবহনকারীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বালু পাচারের সময় স্থানীয় রাজনৈতিক দলের সিন্ডিকেট প্রতিফুট বালুর জন্য ১০ টাকা করে চাঁদা নেয়। একটি ভলগেটে ৫০০ ঘনফুট বালু থেকে তারা চাঁদা নেয় ৫০ হাজার টাকা। দিনে কম-বেশি ৫০টি বাল্কহেড বালু পরিবহন করে থাকে। চাঁদাবাজরা প্রতিদিন এসব বাল্কহেড থেকে অন্তত ২৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে থাকে।

দ্বিতীয় ধাপে ইউনিয়ন ট্যাক্স নেওয়া হয় ৫০০ টাকা। তৃতীয় ধাপে ইজারাদার স্টারলিংক তারিমানের কামরুল ইসলাম ও জিয়ারত প্রতি ফুটে চার টাকা করে প্রতি বাল্কহেড থেকে ২০ হাজার টাকা নেয়। চতুর্থ ধাপে গোয়াইনঘাট ইউনিয়ন পরিষদের নামে ১০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়।

শত শত বিঘা ফসলি জমি নদীতে বিলীন :
গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের উত্তর প্রতাপপুর ও দক্ষিণ প্রতাপপুরসহ বেশকটি গ্রাম পিয়াইন নদীর ভাঙনে বিলীন হওয়ার পথে। বালুখেকোরা ‘দানবযন্ত্র’ ড্রেজার বাসিয়ে দিন-রাত অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে এলাকার শত শত বিঘা ফসলি জমিও নদীতে চলে যাচ্ছে।

প্রতাপপুর গ্রামের সিদ্দিক আহমদ ও সেবুল মিয়াসহ অনেকে জানান- পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের উত্তর প্রতাপপুর, দক্ষিণ প্রতাপপুর ও লুনি গ্রামের খায়রুল আমিন, আজির উদ্দিন, নুরুল ইসলাম, সেলিম মিয়া, ফয়জুল মুরব্বি, তোফায়েল আহমদ, গোলাম মৌলা মেম্বার, সালেহ আহমেদ, সিরাজ মিয়া, রুবেল আহমদ, মানিক মিয়া, রাজ্জাক মিয়া, শুক্কুর মিয়া ও সেলিম মিয়াসহ একটি সংঘবদ্ধ বালুখেকো চক্র পিয়াইন নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলার ফলে এ দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান- গত আড়াই মাস ধরে গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের হাজীপুর এলাকায় পিয়াইন নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে বালুখেকোরা। এতে পিয়াইন নদীর তীরবর্তী পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের হাজীপুর, উত্তর প্রতাপপুর ও দক্ষিণ প্রতাপপুরসহ বেশকটি গ্রামের ফসলি জমি ও বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তারপরও বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি।

হেলেনা বেগম নামে এক গৃহিণী জানান, আগে বাড়ি ভেঙে যাওয়ায় একজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সে আশ্রয়ও এবার ভেঙে গেলে। এখন কোথায় যাবেন- সে চিন্তায় দিন কাটছে।

গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘হাজীপুর এলাকায় পিয়াইন নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের খবর পেয়েছি। পুলিশ বালু উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।’

গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রতন কুমার অধিকারী বলেন, ‘অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জৈন্তাপুরের ইউএনও জর্জ মিত্র চাকমা বলেন, ‘ইজারাবহির্ভূত জায়গা থেকে বালু তুলতে দেওয়া হবে না। আমরা নিয়মিত টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিছু বালুমহাল নিয়ে আদালতে মামলা রয়েছে। ওখানে বালু তোলা নিষিদ্ধ। তবে যেসব জায়গায় বালু তোলার খবর পাচ্ছি, সেখানেই অভিযান চলছে।’


(মূল রিপোর্ট : আমার দেশ)