ঢালাও মামলায় বিচার পাওয়া কঠিন

সুধীর সাহা

বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে রাজনৈতিক বিচারে হাজার হাজার মানুষের নামে পুলিশ মামলা দিয়েছে। এক ঘটনায় শত শত আসামি। বলা বাহুল্য, এ আসামির সবাই হয় বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থক অথবা সরকারবিরোধী জামায়াতসহ অন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মী-সমর্থক। পুলিশ এরপর ছুটেছে এসব মামলার পেছনে। গ্রেপ্তার করা, হয়রানি করা, হয়রানি বাণিজ্য করা সবই হয়েছে। বিষয়টি অজানা ছিল না সরকার এবং সরকারি দলের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের কাছে। বরং তারা প্রচার করেছেন, সবই করা হচ্ছে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দেশের সব অঞ্চলে কাছাকাছি একটি জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ওঠানামা করে। সেই চিত্র সব সময় একই রকম না হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি আনুপাতিক হার বজায় ছিল। আওয়ামী লীগের দুর্দান্ত প্রতিপত্তির সময়েও তাই বিএনপিকে ভালোবাসার মানুষের অস্তিত্ব ছিল বাংলাদেশে; সরবে না হলেও তারা নীরবে ভালোবেসে গিয়েছেন বিএনপিকে। মামলা কিংবা পুলিশের নির্যাতনের ভয়ে হয়তো তারা প্রকাশ্যে এগিয়ে আসতেন না, কিন্তু গোপন ভোটের সুযোগ পেলে তারা তখনও তাদের ভোট বিএনপির মার্কার ওপরই দিতেন। বিষয়টি জানা ছিল আওয়ামী লীগের। তাই প্রকাশ্যে ভোটের দরজা খুলে দিতে তাদের ভয় ছিল। সে কারণেই ভোটের রাজ্যে ছিল তাদের নানা কারসাজির আয়োজন। 


একইভাবে দেখলে এ কথাই সত্য, আজ বিপরীত রাষ্ট্রীয় অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগ-বিরোধী লোকজনের দায়ের করা শত শত মামলায় হাজার হাজার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থককে আসামি করা হয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকরা দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছেন, দেশের অভ্যন্তরে লুকিয়ে রয়েছেন কিংবা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। কিন্তু দিন শেষে তাদের সবাই না হলেও অধিকাংশই মনের মধ্যে আওয়ামী লীগকে ধারণ করবেন। এই বাস্তবতাকে যারা উপলব্ধি করতে পারেন না কিংবা দেখতে পান না, তারা রাজনৈতিকভাবে অন্ধ। যে অন্ধত্ব দখল করেছিল বিগত সরকারের বড় কর্তাদের। তারা মনে করতেন, গত ১৫ বছর তারা জামায়াত কর্মী-সমর্থকদের একেবারে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছিলেন। এমনকি তারা আত্মতৃপ্তিতে ঢেকুর তুলতেন এমনটা ভেবেও যে, দেশে শুধু আওয়ামী লীগের জয়জয়কার। সেই ধারণা পোষণকারী আওয়ামী লীগকে যখন ৫ আগস্ট ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল ছাত্র-জনতার আন্দোলন, ঠিক তার পরে জামায়াতের হাজার হাজার রুকনের সমাবেশ দেখে বোঝা যায়, তারা কীভাবে এতদিন ঘাপটি মেরেছিল! আজ যাদের এটা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে, তারাও হয়তো একদিন দেখবে– এক সময়ে আওয়ামী লীগের লোকজনও ঘাপটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মিছিল-মিটিং করছে বীরদর্পে। এটাই রাজনীতি, বাংলাদেশের রাজনীতি। এখানে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এমন পরিস্থিতিতে একমাত্র সমাধান হতে পারত– যদি সত্যি সত্যি সম্ভব করা যেত ‘ল ইজ নট ব্লাইন্ড’ মতবাদকে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। সময় এবং বাস্তবতা ভিন্ন। কেউই স্রোতের বাইরে থাকতে পারেন না; চেষ্টা করেও পারেন না– প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ল ইজ ব্লাইন্ড’। 

 

এটা ছিল হাসিনা সরকারের পতনের শুরুর দিকের একটি ঘটনা। চট্টগ্রামে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বোন শেখ রেহানা, ছেলে জয়, মেয়ে সায়মা, শেখ রেহানার ছেলে ববি, মেয়ে টিউলিপসহ ৪২৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মামুন আলী। মামলায় বাদীর বক্তব্য গ্রহণের পর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সালাউদ্দিন মামলাটি গ্রহণের আগে প্রাথমিক তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিলে আদালতে বাদীর পক্ষের আইনজীবীদের দ্বারা হট্টগোল শুরু হয়। তারা দাবি করেন, পিবিআইকে তদন্ত নয়; সরাসরি থানায় মামলা নেওয়ার আদেশ দিতে হবে। আদালতের বারান্দায় তখন ১০০ থেকে ১৫০ জন লোক স্লোগান দিতে থাকে আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে। বিচারক বিব্রত হয়ে খাস কামরায় চলে যান। পরে মামলাটি সরাসরি থানায় নেওয়ার আদেশ দেন। যাহোক, আগের সরকারের সময় ভয় ছিল জামায়াত-শিবিরের লোক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আর বর্তমানে ভয় স্বৈরাচার সরকারের দোসর হওয়ার। সুতরাং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ঢালাও মামলা থেকে বিরত থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। 

লেখক : কলামিস্ট