তাবলিগের দুই সাথীকে আটক করে জ ঙ্গি নাটক

  • অবর্ণনীয় নির্যাতন : ৩ বছরে দুজনের জীবন তছনছ

কওমি কণ্ঠ রিপোর্টার :

সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার দয়ামীর গ্রামের শেখ শামসুল হক স্বপনের ছেলে শেখ আহমদ মামুন (২৫) ও একই গ্রামের ছুরাব আলী হাসানের ছেলে মো. হাসান সাঈদ (২৬)। মামুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও হাসান ঢাকার ফরিদাবাদ টাইটেল মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস পাস আলেম। 

গত স্বৈরশাসকের লালিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠে তাদের জীবন। আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বেরিয়ে এসেছে তাদের উপর হওয়া নির্মম নির্যাতনের চিত্র।

২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর নিজ বাড়ি থেকে তাবলিগে যাওয়ার পথে শেরপুর ব্রিজের কাছ থেকে গাড়ি থামিয়ে মামুন ও হাসানসহ চারজনকে অস্ত্রধারী র‍্যাব জিম্মি করে জোরপূর্বক নামিয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে অজানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।

মামুন জানান- ওইদিন সন্ধ্যায় তাদের নিয়ে এক জায়গায় নামিয়ে আড়াই ফুট বাই সাড়ে তিন হাত একটি বাধরুমের মতো রুমে বন্দী করে রাখা হয়। কক্ষটির একপাশে কমোড ছিল। 

মামুন বলেন- সম্ভবত এটি র‍্যাব-৭ এর আয়নাঘর, সেখানে আমাদের রাখা হয়েছিল। খাবার দেওয়ার সময় প্লেটে একদিন র‍্যাব-৭ লেখা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম। তিন বছরে আমার জীবন তছনছ হয়ে গেছে। 

মামুন বলেন- আমি একজন সাধারণ ঘরের ছেলে। আমার বাবা অনেক কষ্ট করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে ছিলেন। আমি তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম। ওরা আমাকে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত এবং পাহাড়ে প্রশিক্ষণে ছিলাম তা শিকার করতে বাধ্য করেছিল। যতদিন ঘুম ছিলাম, ততদিনই চোখ-হাত বাঁধা অবস্থায় বাথরুমে ছিলাম। প্রায় তিন মাস চট্টগ্রাম থাকার পর উত্তরা হেড কোয়ার্টারে পাঠায়। এখানে নির্যাতন হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

'কিবলাহ' কোনদিকে জিজ্ঞাসা করায় চড়, থাপ্পড় মেরে মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। একদিন রাঙামাটিতে গভীর জঙ্গলে পাহাড়ে নিয়ে যায়, সেখানে বলে শেষ পানি খেয়ে নে জনমের মতো। এখনই তোদের ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। পরে আবার আমাদের র‍্যাব-৭ এ ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

মামুন ও সাঈদ জানান- নিখোঁজের পর খবর বেরিয়েছিল, “তাবলিগে বের হয়ে ২০ দিন ধরে নিখোঁজ চার যুবক'। পরে আবার সংবাদ বের হয়েছিল ‘মায়ের আকুতিতে সাড়া দিয়ে চার জঙ্গির আত্মসমর্পণ'।

তারা বলেন, আত্মসমর্পণের নাটক সাজিয়ে প্রেস ব্রিফিং করেছে। আগের দিন আমাদের চুল কাটায়, রোদের মধ্যে সারাদিন বসিয়ে রাখে যেন আমরা পাহাড়ে ছিলাম সেভাবে কালো দেখায়। আমরা যেন বলি- পাহাড়ে গিয়ে ছিলাম সরকারকে নামানোর আন্দোলনের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে। কারণ সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া এই সরকার নামবে না। ঢাকায় ডেকে নেয় আমার মা-বাবাকে। আমাকে শিখিয়ে দেয় আমি যেন মা-বাবাকে ফোন করে বলি “আমরা বাহিরে ছিলাম, এখন সমতলে এসেছি, আমরা আত্মসমর্পণ করব।' তারপর আমাদের ছেড়ে দেবে। কিন্তু আমাদের ছেড়ে না দিয়ে জঙ্গি মামলায় আটক দেখিয়ে রাঙামাটি বিলাইছড়িতে সন্ত্রাসবিরোধী শারক্কীয়া মামলায় আটক দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জ কোর্টে হাজির করে চট্টগ্রাম জেলে পাঠায়।

মামুন বলেন, কারাগারে পাঠানোর পর আমাদের কনডম সেলে রাখা হয়েছিল। বাইরে হাঁটতে দিত না।

মামুন বলেন- এই প্রথম আমি কিছুটা সাহস করে মিডিয়ার সামনে এসেছি। কিন্তু আমি এখনো নির্যাতনকারী পুলিশ ও র‍্যাব সদস্যের নাম বলতে ভয় পাচ্ছি। কারণ তারা এখনো দায়িত্ব পালন করছে। তাদের লোকজনও আছে। তাই ক্ষতির ভয়ে আমি তাদের নাম বলতে চাই না ।

স্ত্রীকেও নানাভাবে অসম্মান ও হয়রানি করেছে আমার দেশ-এর সঙ্গে হাসান সাঈদ বলেন, আমি সদ্য দাওরায়ে হাদিস পাস করা নববিবাহিত স্ত্রীকে রেখে তাবলিগে যেতে চেয়েছিলাম। যাওয়ার পথে আমিও গুম হই। আমাদের চারজনকে একসঙ্গে গুম করা হলেও মামুন ছাড়া অন্য দুজনকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমরা জানি না।

তিনি বলেন, এমন সব বিষয় আমাদের জিজ্ঞাস করত যেগুলো আমরা জানতামই না। রমজান মাসেও ২৪ ঘণ্টা আমাদের হাত-চোখ বাঁধা ছিল। তারা শুধু ইন্ডিয়া, মোদি, হাসিনা, শারক্কীয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ আর উত্তর না দিলে নির্যাতন করত। পরিবার ও আমার স্ত্রীকেও নানাভাবে অসম্মান ও হয়রানি করেছে। মামুনের সঙ্গে আমাকেও অনেক নাটকের পর জেলে পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তী সময়ে জামিনে মুক্তি লাভ করি আমি চাই আমাদের যেন এই জঙ্গি মামলা থেকে খালাস দেওয়া হয়।

সাঈদ ও মামুন জানান- অনেক নাটক সাজিয়ে ৫ আগস্টের পর জঙ্গি মামলায় তাদের আদালতে সোপর্দ করে। এর এক বছর পর ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর ৯ সেপ্টেম্বর প্রায় তিন বছর পর তারা জামিন লাভ করে পরিবারের কাছে ফিরে আসেন। এখনো রাঙামাটি থানায় আসামি হিসেবে হাজিরা দিতে হচ্ছে তাদের।