কে এম তাহমীদ হাসান :
সিলেটের মোট ছয়টি সংসদীয় আসনের মধ্যে সিলেট-১ এর পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয় সিলেট-৩ আসনকে। দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে সিলেট অঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী এলাকা। সিলেট শহরের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হওয়ায় এটি নগর ও গ্রামীণ রাজনীতির মিলনস্থল হিসেবেও বিবেচিত।
এ অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষ যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে প্রবাসী। তাদের রেমিট্যান্সে গড়ে উঠেছে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও আবাসন খাতের প্রবল অর্থনৈতিক প্রবাহ। আবার ফেঞ্চুগঞ্জে রয়েছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম ফেঞ্চুগঞ্জ ইউরিয়া সার কারখানা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, যা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এসব কারণে সিলেট-৩ আসনের রাজনৈতিক গুরুত্ব বরাবরই বিশেষভাবে আলোচিত।
ঐতিহ্যগতভাবে এটি বিএনপি ঘরানার ভোটারপ্রধান আসন হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক সমীকরণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। বিএনপি এখনো শক্ত অবস্থানে থাকলেও দলের অভ্যন্তরীণ মনোনয়ন প্রতিযোগিতা তীব্র আকার ধারণ করেছে।
ধানের শীষ প্রতীকের টিকিট পেতে মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন যুক্তরাজ্য বিএনপি সভাপতি ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এম. এ. মালিক, দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার এম. এ. সালাম, জেলা বিএনপি সভাপতি আব্দুল কাইয়ূম চৌধুরী, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক আব্দুল আহাদ খান জামাল, নগর বিএনপি সহ-সভাপতি ব্যারিস্টার রিয়াসাদ আজিম আদনান এবং যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা ড. মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দিন এমবিই।
দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করে আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় থাকা এম. এ. মালিক এবার দেশে ফিরে সরাসরি নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন। ব্যারিস্টার এম. এ. সালাম দেড় যুগ ধরে এ আসনে সক্রিয় থেকে তৃণমূল পর্যায়ে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন। জেলা বিএনপি সভাপতি আব্দুল কাইয়ূম চৌধুরী সংগঠনের নেতৃত্বে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নাম। আন্দোলন-সংগ্রামে একাধিকবার কারাবরণ করা আব্দুল আহাদ খান জামালও মাঠে নতুন উদ্যমে কাজ করছেন। প্রয়াত এম. এ. হকের পুত্র ব্যারিস্টার রিয়াসাদ আজিম আদনান নবীন প্রার্থী হিসেবে এলাকায় দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন।
অন্যদিকে ইসলামী ঘরানার দলগুলোর মধ্যে সংগঠিতভাবে মাঠে রয়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। দলটির একক প্রার্থী মাওলানা নজরুল ইসলাম ইতিমধ্যেই দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জে ব্যাপক গণসংযোগ শুরু করেছেন। তিনি জমিয়তের কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক সম্পাদক, সিলেট জেলা দক্ষিণ জমিয়তের সহ-সভাপতি, সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্র জমিয়ত সভাপতি এবং সিলেট জেলা হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক।
ধর্মীয় অঙ্গনের প্রভাবশালী এই আলেমের পক্ষে স্থানীয় কওমি মাদরাসা, আলেম সমাজ ও ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে।
ঐতিহাসিকভাবে এই আসনে জমিয়তের অবস্থানও শক্ত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে খেজুরগাছ প্রতীকে আল্লামা নূরউদ্দিন গহরপুরী (রাহ.) এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে ইসলামী রাজনীতির ঐতিহ্য তৈরি করে। মাওলানা নজরুল ইসলাম সেই ধারারই উত্তরসূরি হিসেবে এখন মাঠে সক্রিয়। তিনি খলীফায়ে মাদানী আল্লামা বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা (রাহ.)-এর নাতিন জামাই এবং জামেয়া রেঙ্গা পরিবারের সদস্য। ফলে জামেয়া রেঙ্গা, জামেয়া গহরপুর ও তিন উপজেলার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সমর্থকরাও তার পক্ষে কাজ করছেন।
এছাড়া খেলাফত মজলিসের মাওলানা দিলওয়ার হোসাইন তিন উপজেলায় তার বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে বিলেতে থেকেও আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তুলে আলোচনায় আসা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার নুরুল হুদা জুনেদও নবগঠিত রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে কাজ করছেন। দক্ষিণ সুরমা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী মাওলানা লোকমান আহমদ দল থেকে মনোনয়ন পেয়ে প্রচারণায় সক্রিয় রয়েছেন।
এ ছাড়াও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা লুৎফুর রহমান কাসেমী এবং ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা রেজাউল হক চৌধুরী রাজু নিজ নিজ অবস্থান থেকে মাঠে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
সব মিলিয়ে সিলেট-৩ আসনে ইসলামী দলের ঐক্যবদ্ধ তৎপরতা যেমন দৃশ্যমান, তেমনি বিএনপির অভ্যন্তরীণ মনোনয়ন প্রতিযোগিতাও চরমে পৌঁছেছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মীয় নেতৃত্ব ও প্রবাসী প্রভাব- সব মিলিয়ে আসনটি এখন জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচিত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনগুলোর একটি।