সাবেক ছাত্রলীগ নেতার আশির্বাদে ভ য়ং ক র সিলেটের রায়হান

কওমি কণ্ঠ রিপোর্টার : 
সিলেটের যুবক। নাম মো. রায়হান। ঢাকার গিয়ে হয়েছেন ভয়ংকর প্রতারক। গড়ে তুলেছিলেন ভুয়া দুদক টিম। সরকারি অফিসসহ বিভিন্ন কার্যালয়ে সেই ভুয়া টিম নিয়ে ভুয়া অভিযান চালাতেন আসল দুদকের মতো। দালাল ধরাসহ নানা অনিয়মের সুযোগে হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা।

কিন্তু খবর পেয়ে গেলো আসল দুদক। দুই সহযোগীসহ তাকে পাকড়াও করা হলো। আজ মঙ্গলবার আদালতের নির্দেশে এ তিন প্রতারককে নেওয়া 
হয়েছে রিমান্ডে।

জানা যায়, গত বছরের ১২ নভেম্বর বেলা সাড়ে ১১টায় হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক বজলুর রশীদের কক্ষে হঠাৎ দ্রুতগতিতে ঢুকে পড়েন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ইউনিফর্ম-সদৃশ পোশাক পরা কয়েকজন। সবার বুকে ঝোলানো ছিলো ছবিযুক্ত আইডি কার্ড। তাদের নিরাপত্তায় কক্ষে অবস্থান নেয় হবিগঞ্জ সদর থানার সাব-ইন্সপেক্টর আলী আকবরের নেতৃত্বে একদল পুলিশ।

তাদের দেখেই দাঁড়িয়ে যান সহকারী পরিচালক বজলুর রশীদ। দুদকের ইউনিফর্ম-সদৃশ পোশাক পরা ব্যক্তিদের একজন বলেন, ‘আমরা অ্যান্টি করাপশন থেকে এসেছি। আমি সৈয়দ রায়হান, ডাইরেক্টর অপারেশন। আমরা বিআরটিএ ও পাসপোর্ট অফিসকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য এবং সঠিক সেবা নিশ্চিত করতে অভিযান চালাই। আমরা এই অফিসের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পেয়েছি। তবে প্রায় ২০-২৫ মিনিট পরিদর্শন করেও অভিযোগ অনুযায়ী তেমন কিছু পাইনি।’

পরে সৈয়দ রায়হান ও বজলুর রশীদের সঙ্গে প্রায় ৭ মিনিট কথোপকথন হয় স্থানীয় দালাল, পাসপোর্ট অফিসের সেবা প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে। এ সময়ে এক মুহূর্তের জন্য নিজের চেয়ারে বসেননি বজলুর রশীদ। কথা শেষে বজলুর রশীদকে ধন্যবাদ দিয়ে কক্ষ ত্যাগ করেন সৈয়দ রায়হান। 

এর আগে বেলা ১১টায় ওই পাসপোর্ট অফিসে প্রবেশের সময় সৈয়দ রায়হান ও তার লোকজন দালাল ভেবে স্থানীয় আজাদ হোসেন, জলিল মিয়াসহ কয়েকজন সেবাগ্রহীতাকে জেরা করেন। পাসপোর্ট অফিসের আঙুলে ছাপ নেওয়া ও ছবি তোলার রুমে গিয়েও কিছু সময় অবস্থান করেন। সেখানে ছবি তুলতে থাকা এক নারীকেও নানা রকম প্রশ্ন করেন। দায়িত্বে থাকা রেকর্ডকিপার তৌহিদুল ইসলামকে সঠিকভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন। একে একে সহকারী অ্যাকাউন্ট্যান্ট শুভ কুমার দে, অ্যাকাউন্ট্যান্ট বাদল পালসহ পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও জেরা করেন রায়হান। 

মূল ভবন পরিদর্শন শেষে বেলা সাড়ে ১১টায় পাসপোর্ট অফিস থেকে বের হয়ে দালাল হিসেবে অভিহিত করে স্থানীয় সাইফুল ইসলাম, ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস এজেন্সির এক কর্মীসহ কয়েকজনকে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করে দলটি। তবে জরিমানার কোনো রসিদ দেওয়া হয়নি। কারণ প্রতিজনকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। পরে সমঝোতা সাপেক্ষে জরিমানা কমানো হয়েছে। 

এর আগে ৭ নভেম্বরেও একই ব্যক্তিরা একই কায়দায় হবিগঞ্জ বিআরটিএ কার্যালয়ে যান। সে সময় তাদের নিরাপত্তা দেন হবিগঞ্জ সদর থানার এসআই সামাদ আজাদসহ একদল পুলিশ। রায়হানের নেতৃত্বে অ্যান্টি করাপশনের লোক পরিচয় দেওয়া দলটি বিআরটিএর এনরোলমেন্ট অফিসার আবুল হোসেন রানাকে মাস্ক খুলে কথা বলতে বাধ্য করেন। তাকে সৎ থাকার জন্য প্রতিজ্ঞা করান রায়হান ও তার দল। এরপর বিআরটিএ চত্বরে ঘোরাফেরা করা কয়েকজনকে দালাল বলে অভিহিত করে জরিমানা করেন।

চক্রটি শুধু সরকারি অফিসেই নয়, জমিজমার বিরোধ, পারস্পরিক দেনা-পাওনা, পারিবারিক দ্বন্দ্বসহ ফৌজদারি সব ধরনের বিরোধের ক্ষেত্রে বিচার-সালিশ করতে সিলেট বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে অ্যান্টি করাপশনের লোক পরিচয়ে ‘অপারেশন’ চালিয়েছে।

তাদের একটি ফেসবুক পেজে দেখা গেছে, এভাবে গত ৮ আগস্ট থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অন্তত ১৫৩টি স্থানে তারা অভিযান চালিয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের নিরাপত্তায় স্থানীয় পুলিশ দায়িত্ব পালন করেছে।

ইতোমধ্যে জানা গেছে, এরা একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে তাদের কোনো রকম সম্পৃক্ততা বা যোগাযোগ নেই। 

আরও জানা গেছে- ভুয়া দুদক চক্রের মূল হোতা সৈয়দ রায়হান নিজেকে দুর্নীতি দমন কার্যক্রমের অপারেশন ডিরেক্টর হিসেবে পরিচয় দিয়ে সারা দেশ চষে বেড়ান। গত ২৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ঘোষণা দেন- তিনি আগামী পাঁচ মাস নতুন কোনো অভিযোগ গ্রহণ করবেন না। সরাসরি যোগাযোগ না করার আহ্বানও জানান তিনি।

চক্রের অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন নেত্রকোনার সাইফুল ইসলাম, পটুয়াখালীর সোলাইমান মুফতি, একই জেলার গলাচিপা উপজেলার সিয়াম মাহমুদ মোবারক ও হবিগঞ্জ সদরের রনি আহমেদ পায়েল।

প্রতারক চক্রটি গত পাঁচ মাসে দেশের ৪০টি জেলার বিভিন্ন এলাকায় দুই শতাধিক অভিযান চালিয়েছে। এর মধ্যে ১৫৩টি অভিযানের ভিডিও ফুটেজ ইউটিউব ও সৈয়দ রায়হানের ফেসবুক পেজে দেখা গেছে।

তাদের পেজ সূত্রে জানা যায়- ভুয়া অভিযানগুলোর মধ্যে ২৩ সেপ্টেম্বর সিলেটে, ২৫ নভেম্বর সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানায় ও ১৩ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে পুলিশের উপস্থিতিতে চক্রটিকে একই ধরনের অভিযান ও বিচার-সালিশ করেছে।

এছাড়া চক্রটি স্থানীয় পুলিশের উপস্থিতিতে গত ২৩ ডিসেম্বর সিলেট সদরে ইংল্যান্ড প্রবাসী আবদুল জলিলের বাড়ির গেট ও ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। গত বুধবারও (১ জানুয়ারি) সিলেটের একাধিক স্থানে এমন অভিযানের কথা জানা গেছে।

এভাবে গত পাঁচ মাসে দুর্নীতি ও অপরাধ দমন অপারেশনের নামে অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সৈয়দ রায়হান ও তার দল।

আরও জানা গেছে, প্রতারক চক্রের মূল হোতা সৈয়দ রায়হানের প্রকৃত নাম মো. রায়হান। গ্রামের বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুমার কদমতলির পার্শ্ববর্তী হবিনন্দী এলাকায়। বাবার নাম মঈন উদ্দিন ও মায়ের নাম লুৎফুন নাহার। সাধারণ পরিবারে বেড়ে উঠা রায়হান থাকেন ঢাকার কদমতলী থানার শনির আখড়া গ্যাস রোডের ৩৮১ নম্বর বাড়িতে। ২০১৭ সালে ঢাকায় গিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির ও প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালকের চাকরি শুরু করেন তিনি। গাড়িচালকদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশনে গাড়িচালকের কাজে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় সখ্য গড়ে ওঠে ছাত্রলীগের কিছু সদস্যের সঙ্গে। সেই সূত্রে পরিচয় হয় ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর। তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ সম্পর্কের ভিত্তিতে রাব্বানীর সংগঠন টিম পজিটিভে যোগ দেন রায়হান। এরপর তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পান এই রায়হান। ফলে দেশের পুলিশ বিভাগে প্রভাব খাটিয়ে বিগত সরকারের সময়ে নানা রকম অপকর্ম চালিয়েছেন। সরকার পরিবর্তনের পরও অদৃশ্য শক্তিতে দুদকের ভুয়া টিম গড়ে আরও জোরালোভাবে অপকর্ম করে যাচ্ছিলেন রায়হান ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা।

এদিকে, সংবাদমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পরপরই চক্রটির সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং তাদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন দুদকের চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মোমেন। 

ওই ভুয়া দুদক কর্মকর্তা তার কর্মকাণ্ড প্রচার করতো ফেসবুকে! দেখুন ভিডিও :

দুদকের পরিচালক আবুল হাসনাতসহ পাঁচ সদস্যের বিশেষ টিমকে আদেশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব পেয়েই দুদকের বিশেষ টিমের সদস্যরা ওই চক্রের সদস্যদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে মাঠে নামেন। 

অবশেষে সোমবার (৬ জানুয়ারি) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা জাহির করতে রাজধানীতে সংস্থার প্রধান কার্যালয়ের সামনে ফেসবুকে লাইভ করতে এসে ধরা পড়েন এ চক্রের ৩ প্রতারক। তারা হলেন- সিলেটের সেই মো. রায়হান ওরফে সৈয়দ রায়হান, সোলায়মান মুফতি ও রফিকুল ইসলাম সম্রাট। 

মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) পুলিশের তাদের আদালতে তুললে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহীন রেজা প্রতারকরদের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন। এর আগে রাজধানীর পল্টন থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে সাতদিন জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। 

তবে আদালতে আসামিদের রিমান্ড বাতিল করে জামিন চেয়ে আবেদন করেছিলেন তাদের আইনজীবীরা। 

এর আগে গ্রেফতারের পর রাজধানীর পল্টন থানায় প্রতারণার অভিযোগে দুদকের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন বাদী হয়ে ১৪ জনকে আসামি করে মামলা করেন।

মামলায় পটুয়াখালীর সোলাইমান মুফতি, সিয়াম মাহমুদ মোবারক, হবিগঞ্জের রনি আহেমদ পায়েলসহ অজ্ঞাত পরিচয়ে আরও আটজনকে আসামি করা হয়েছে।