শবে বরাতের প্রামাণ্য : করণীয়-বর্জনীয়

মাওলানা আব্দুস সামাদ
কিছু সৃষ্টি আল্লাহর কাছে সেরা। কিছু ফেরেশতা শ্রেষ্ঠ। কিছু কিতাব শ্রেষ্ঠ। কিছু মানুষ শ্রেষ্ঠ। কোনো কোনো ইবাদত আল্লাহ পাকের কাছে খুবই গ্রহনযোগ্য। এভাবে মহাহিম আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কখনো কোনো মাসকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কখনো কোনো দিনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কখনো আবার কোনে কোনো রাতকে গুরুত্ব দিয়েছেন। সেই গুরুত্বপূর্ণ মহিমান্বিত রজনীসমূহের একটি রজনী হচ্ছে পবিত্র শাবান মাসের অর্ধ রজনী বা শাবান মাসের ১৪ তম তারিখের দিবাগত রাত। যা আমাদের পরিভাষায় শবে বরাত নামে অভিহিত। শব অর্থ রাত। বরাত অর্থ মুক্তি। 'শবে বরাত' এই শব্দবন্ধনের যৌথ অর্থ হলো মুক্তির রাত।  আল্লাহ পাক এ রাতে অসংখ্য পাপীদের ক্ষমা করে দেন। সেজন্য এই রাতকে শবে বরাত বা মুক্তির রাত বলা হয়। হাদিস শরিফে শবে বরাতকে 'লাইলাতুল মিন নিছফি শাবান' অর্থাৎ অর্ধ শাবানের রাত বলে বর্ণিত হয়েছে। এজন্য ১৪ই শাবানের দিবাগত রাত অর্থাৎ ১৫ই শাবানের রাতকে উর্দু, ফার্সি ও বাঙলা ভাষায় 'শবে বরাত' বলা হয়। এ রাতের অনেকগুলো নাম রয়েছে; যেমন, লাইলাতুল মুবারাকাহ অর্থাৎ বরকতের রাত। লাইলাতুল বারাআহ অর্থাৎ মুক্তির রাত। লাইলাতুর রাহমাহ অর্থাৎ রহমতের রাত, লাইলাতুস সাক অর্থাৎ চুক্তির রাত।

শবে বরাতের প্রামাণিকতা: হযরত আয়শা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল একদিন বললেন, আয়শা। তুমি কি জানো, শবে বরাতে কী কী ঘটে? আয়শা রা. বললেন: কী কী ঘটে? হে আল্লার রাসুল। রাসুল সা. বললেন: এ রাতে আগত বছরের অনাগত বাচ্চাদের তালিকা করা হবে এবং কত জন লোক মারা যাবে তাদের তালিকা করা হবে। এ রাতে মানুষের আমলসমূহ ওঠানো হয় এবং অবতীর্ণ করা হয় তাদের সমুহ রিযিক।

হযরত মুআয ইবনে জাবাল রাযি. থেকে বর্ণিত, নবিজি সল্লাল্লাহু বলেছেন: আল্লাহ তায়ালা শবে বরাতে তার সমস্ত বান্দার প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে থাকান। এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।

হযরত আলি রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেছেন যখন শাবানের অর্ধ রজনী অর্থাৎ শবে বরাত আসে। তখন তোমরা নামাজে দাঁড়িয়ে যাও এবং অনাগত দিনে রোজা রাখো। কেননা আল্লাহ পাক ঐ রাতে সূর্যাস্তের পর পৃথিবীর আকাশে আবির্ভূত হন। অতপর এই বলে ডাকতে থাকেন, কোন প্রার্থনাকারী আছো কি? ক্ষমা করে দেবো। কোন রিযিকপ্রার্থী আছো কি? রিযিক দেবো। কোন বিপদগ্রস্ত আছো কি? মুক্তি দেবো। ঠিক এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত ডাকতে থাকেন।

বিশিষ্ট তাবেয়ি আতা ইবনে ইয়াসার বলেন- শবে কদরের পরে শবে বরাত থেকে উত্তম কোনো রাত নেই। হযরত খালিদ ইবনে মাদান, লুকমান ইবনে আমির, ইসহাক ইবনে রাহুইয়াহ সহ প্রমুখ তাবেয়ি রয়েছেন, যারা শবে বরাতকে মহিমান্বিত রাত বলে মনে করেন।

চার মাযাহাবের অনেক ইমাম শবে বরাতকে গুরুত্ব দিতেন এবং শবে বরাতের বৈধতার কথা বলেছেন।

হানাফি মাযহাবের আল্লামা হাসকাফি রহ. বলেন; মুস্তাহাব কাজ সমূহের মধ্য থেকে কয়েকটি হলো, দুই ঈদ ও শবে বরাতে জাগ্রত থেকে ইবাদাত করা।

ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেন- পাঁচটি রাতে দুয়া কবুল হয়, সেগুলোর একটি হলো শবে বরাত।

হামবলি মাযহাবের আল্লামা মারদাবি রহ. বলেন: সম্মানিত চার মাস ও পুরো শাবানে রোজা রাখা মুস্তাহাব।

আল্লামা ইবনুল জাওযি রহ. বলেন; শাবান মাসের রোযার মধ্যে ১৫ শাবানের রোজা গুরুত্বপূর্ণ।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন; শবে বরাতের ফজিলত রয়েছে, কিছু সংখ্যক সালাফ তথা পূর্ববর্তী আলেম এ রাতে নফল নামাজ পড়তেন।

আল্লামা ইবনুল হাজ রহ. বলেন: শবে বরাতের অনেক মাহাত্ম্য ও বিশাল কল্যাণ রয়েছে, এ রাতকে সালফে সালেহিন মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতেন। এই রাত আগমনের পূর্বে ইবাদাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন।

শবে বরাতে উপলক্ষ্যে যে সকল কাজ করণীয়: এ রাতের নির্দিষ্ট কোনো আমল নেই। নির্দিষ্ট কেনো নামাজ নেই। ইবাদাতের জন্য এই রাত ব্যাপক। যে কোনো ইবাদাত করা যাবে। নির্দিষ্ট কোনো ইবাদাত করতে বাধ্যবাধকাতা নেই।

এ রাতের আমল সম্পর্কে ইমাম বায়হাকি রহ. এর 'শুআবুল ঈমান' এর নিম্নোক্ত হাদীসটি লক্ষণীয়। হযরত আলা ইবনুল হারিছ রাহ. থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এতো দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো, তিনি হয়তো মৃত্যু বরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা। অথবা বলেছেন: হে হুমায়রা। তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, এমনটি নয়, হে আল্লার রাসুল! আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবিজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন: এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত অর্থাৎ শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ-পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামায পড়া, যাতে সেজদাও দীর্ঘ হবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে কাম্য।

আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবি রহ. 'আল আছারুল মারফুআ ফিল আখবারিল মাওজুয়া' গ্রন্থে লিখেছেন যে, শবে বরাতে জেগে জেগে ইবাদত করা এবং যেকোনো নফল আমল করা যাতে আগ্রহ বোধ হয়, তা আদায় করা মুস্তাহাব। এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই। এ রাতে মানুষ ইচ্ছামাফিক নামায পড়ত পারে, তবে এ ধারণা ভুল যে, এ রাতের বিশেষ নামায রয়েছে এবং তার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। যেসব বর্ণনায় এ ধরনের কথা পাওয়া যায় সেগুলো 'মওযু' (বানানো) বা যযিফ (দুর্বল)। তবে এ রাত একটি ফযিলতপূর্ণ রাত এবং এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগি করা মুস্তাহাব। এ বিষয়টি সহীহ হাদীস থেকেও প্রমাণিত। মোটকথা, এ রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করা যেমন ভুল তদ্রুপ মনগড়া কথাবার্তায় বিশ্বাসী হওয়াও ভুল।

জগতবিখ্যাত ফকিহ আল্লামা তাকি উসমানি দা. বা. বলেন; এ রাতে ইবাদাতের জন্য বিশেষ কোনো নিয়ম কানুনের কথা হাদিসে উল্লেখ নেই যে, এই নিয়মে ইবাদাত করতে হবে। তাই কেউ যদি এমন নিয়ম করে যে, শবে বরাতে এতো রাকাত নামাজ

পড়তে হবে, এই এই সুরা পড়তে হবে। এ ধরণের কোনো কিছুই হাদিসভিত্তিক প্রমাণিত নয়। বরং কেউ চাইলে নফল ইবাদাত যার যেরকম সুবিধা সেভাবে আদায় করবে। এ ব্যাপারে শরিয়তের কোনো আবশ্যকীয় নিয়ম-কানুন নেই। নফল ইবাদাত যেমন নামাজ, তেলাওয়াত, যিকির, তাসবিহ-তাহলিল দুয়া-দুরুদসহ যাবতীয় ইবাদাত করা যেতে পারে।

আল্লামা মুল্লা নিজামুদ্দিন রহ. বলেন; কবর যিয়ারতের সর্বোত্তম দিন চারটি। সোমবার, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার। তদ্রুপ বরকতময় রাতেও কবর যিয়ারত করা উত্তম। তন্মধ্যে বিশেষত শবে বরাত।

জাষ্টিস আল্লামা তাকি উসমানি দা. বা. বলেন; যেহেতু নবী সা. জীবনে একবার কবরস্থানে গিয়েছেন বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। তাই কখনো যিয়ারত করবে, কখনো বাদ দিবে। কর্তব্য ভেবে গুরুত্ব সহকারে পালন করবে না।

শবে বরাতের পরের দিন অর্থাৎ ১৫ শাবানের রোজা রাখা কিছু সংখ্যক ফকিহদের দৃষ্টিতে জায়েজ। আবার কিছু সংখ্যক ফকিহগণ মুস্তাহাব বলেছেন। এ বিষয়ে ইমাম ইবনে রজব রহ. বলেন, শরিয়তে প্রত্যেক মাসে 'আইয়ামে বিজ' তথা ১৩-১৪-১৫ তারিখে রোজা রাখা মুস্তাহাব। শবে বরাতের পরের দিন ১৫ শাবান 'আইয়ামে বিজ' এর অন্তর্ভুক্ত। তাই এ দিনে রোজা রাখা এমনিতেই মুস্তাহাব বা সুন্নত। সুতরাং ১৫ শাবানে রোজা রাখা মুস্তাহাব বলতে কোনো সমস্যা নেই। তবে হ্যাঁ, মুস্তাহাব 'আইয়ামে বিজ' এর কারণে, শবে বরাতের কারণে নয়। কেউ চাইলে শাবানের ১৩-১৪-১৫ তারিখের রোজা মুস্তাহাব হিসেবে রাখতে পারে। 

পনেরো শাবানের রোযা সম্পর্কে আল্লামা আশরাফ আলি থানভি রহ. যে 'মাসনুন' বলেছেন তার অর্থ হল মুস্তাহাব। তিনি বলেন, তবে এটাকে শবে বরাতের রোযা বলবে না। শেষের দুই দিন ছাড়া গোটা শাবানেই রোজা রাখা মুস্তাহাব। তাছাড়া প্রতি মাসের 'আইয়ামে বিজ' অর্থাৎ ১৩-১৪-১৫ তারিখে রোযা রাখা মুস্তাহাব। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ দিনের রোযা রাখলে ইনশাআল্লাহ সওয়াব পাওয়া যাবে।

শবে বরাত উপলক্ষ্যে যে সকল কাজ বর্জনীয়: 
১. শবে বরাতকে শবে কদরের সমান মনে করা ভুল। ২. খিচুড়িপ্রথা: শবে বরাত উপলক্ষ্যে খিচুড়ি, শিরনি ও বনরুটিজাতীয় খাবার-দাবার বন্টন করা গর্হিত কাজ। সাহাবা, তাবেয়িন, তাবয়ে-তাবেয়িনের যুগে এসবের প্রচলন ছিলো না। ৩. আতশবাজি ও ফটকা বাজানো: এই মহান রাতটি ফটকা ও আতশবাজির মাধ্যমে আনন্দ ফুর্তি করার জন্য নয়। বরং এই রাতটি ইবাদাত ও ক্ষমা প্রার্থনার।

৪. চেরাগপ্রথা: শবে বরাত উপলক্ষ্যপ ঘর-বাড়ি- মসজিদ গোরস্থান সহ বিভিন্ন জাগায় বাতি, মোমবাতি ইত্যাদি জ্বালানল হয়ে থাকে। যা বিধর্মীদের কালচার। এটা নিশ্চয় বিধর্মীদের কর্মকাণ্ডের সাদৃশ্য।

৫. হালওয়া রুটি: এ রাতে বিশেষভাবে হালওয়া রুটি মোরগ-পোলাও রান্না করা হয় এবং ঈদের দিনের মতো আপ্যায়ন করা হয়। এগুলো পরিত্যাজ্য কাজ।

৬. কবরস্থান বা মাজারে দলবেঁধে গমন করা। এটা গর্হিত কাজ। সালাফরা এধরনের কাজ করেননি।

৭. এ রাতে নির্দিষ্ট সময়ে দলবেঁধে মসজিদে শোরগোল করা জায়েজ নয়।

৮. ঘরে কিংবা মসজিদে গুরুত্বের সহিত গোলাপজল ছিটানো, আতরবাতি জ্বালানো বেদআত। খাইরুল কুরুনের কেউ এরকম কাজ করেননি।

৯. মেহেদি দেয়া: এ রাতে গুরুত্ব সহকারে মেহেদি ইত্যাদি দেওয়া গর্হিত কাজ।

১০. এ রাতকে উপলক্ষ্য বানিয়ে নির্দিষ্ট কোনো আমল করা পরিত্যাজ্য।

আল্লাহ পাক যেনো যাবতীয় মন্দ ও গর্হিত কাজ থেকে মুসলিম উল্লাহকে হেফাজত করেন এবং শবে বরাতের সমস্ত রাহমাহ ও বারাকাহ প্রত্যেক মুসলমানকে দান করেন। আল্লাহুম্মা আমিন।

লেখক : শিক্ষক, কবি ও সাহিত্যিক