কওমি কণ্ঠ রিপোর্টার :
সিলেটে আলোচিত রায়হান আহমদ (৩২) হত্যা মামলার প্রথম আরগুমেন্ট আজ মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) অনুষ্ঠিত হবে। আজ দুপুরে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতে এ আরগুমেন্ট হওয়ার কথা রয়েছে।
পুলিশ হেফাজতে সিলেটের চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ড ঘটে ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর। দীর্ঘ ৪ বছর এ মামলার কার্যত কোনো অগ্রগতি ছিলো না। নানা বাহানায় আসামিরা মামলাটির দীর্ঘসূত্রিতার চেষ্টা করছিলেন বলে নিহতের পরিবারের অভিযোগ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অবশেষে আজ এ মামলার প্রথম আরগুমেন্ট (আইনজীবিদের যুক্তি-তর্ক) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
এদিকে, মামলার প্রধান আসামি পুলিশের বরখাস্তকৃত এস. আই আকবর হোসেন ভূইয়া ৫ আগস্টের পর একাধিকবার জামিন আবেদন করেছেন। এর মধ্যে একটি আবেদনের শুনানি আজ অনুষ্ঠিত হবে।
এসব তথ্য কওমি কন্ঠকে সোমবার (২৪ মার্চ) রাতে নিশ্চিত করেছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবুল ফজল চৌধুরী।
২০২০ সালের ১১ অক্টোবর ভোররাতে সিলেট মহানগরের আখালিয়ার নেহারীপাড়ার বাসিন্দা রায়হান আহমদ বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন। ওই রাত ৩টা ৯ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে স্বাভাবিক অবস্থায় রায়হানকে ফাঁড়িতে ধরে আনে পুলিশ। পরদিন সকাল ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে রায়হানকে কাঁধে করে ফাঁড়ি থেকে বের করা হয়। ৬টা ৪০ মিনিটে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং ৭টা ৫০ মিনিটে মারা যান রায়হান।সিলেট জেলা ট্যুর প্যাকেজ
পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠে- মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্যে এস.আই আকবরের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরা রায়হানকে পিটিয়ে হত্যা করেন। ওইদিনই ময়না তদন্ত শেষে তার লাশ দাফন করা হয়। এরপর ১৫ অক্টোবর কবর থেকে রায়হানের লাশ উত্তোলন করে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুনরায় ময়না তদন্ত করা হয়।
নির্যাতন করে রায়হানের হাতের দু'টি আঙ্গুলের নখ তুলে ফেলেন এস.আই আকবর। ময়না তদন্তে রায়হানের শরীরে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৪টি আঘাত ছিল গুরুতর। নির্যাতনের সময় রায়হানের আর্তচিৎকারে ফাঁড়ির পার্শ্ববর্তী কুদরত উল্লা রেস্ট হাউসের বর্ডারদেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো পরবর্তীতে জানান তারা।
ঘটনার পরদিন রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বাদী হয়ে সিলেট কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-২০, ধারা ৩০২/৩৪ দণ্ডবিধি তৎসহ নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ১৫ (১) (2) (৩) ২০১৩। প্রথমে কোতোয়ালি থানার এস আই আব্দুল বাতেন মামলাটি তদন্ত করেন। পরে তুমুল সমালোচনার মুখে ১০ অক্টোবর পুলিশ সদর দপ্তর মামলাটি থানা থেকে পিবিআই-তে স্থানান্তর করে।
ঘটনার পর আকবর হোসেন ভূঁইয়া সীমান্ত হয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। ঘটনার ২৮ দিন পর ৯ নভেম্বর সকালে কানাইঘাটের না সীমান্ত এলাকায় ভারতের অভ্যন্তরে খাসিয়াদের হাতে আটক হয় আকবর। পরে তাকে বিজিবি আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। ওইদিনই তাকে গ্রেফতার করে সিলেটে নিয়ে আসা হয়।
ঘটনার প্রায় এক বছর পর (২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর) সিলেটের তৎকালীন অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আব্দুল মোমেন প্রধান আসামি আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ ৫ আসামির উপস্থিতিতে মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। এর আগে ওই বছরের ৫ মে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআই সিলেটের পরিদর্শক আওলাদ হোসেন ৫ আসামির বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩০২/২০১/৩৪ তৎসহ নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন ২০১৩ এর ১৫(১) (২) (৩) ধারায় সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্রটি দাখিল করেন। টানা ২০২ দিনের তদন্ত শেষে দেয়া অভিযোগপত্রে দারোগা আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ৫ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জনকে আসামি করা হয়।
মামলার মূল অভিযোগপত্র ছিলো ২২ পৃষ্ঠার। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৬৯ জনকে। সাক্ষীদের মধ্যে ১০ জন আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। অভিযোগপত্রে ৫ পুলিশসহ ৬ জনের নাম উঠে আসে। ৬ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়।
তারা হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আপগঞ্জ থানার বাগইর গ্রামের মো. জাফর আলী ভূঁইয়ার ছেলে তৎক্ষালীন বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এস. আই আকবর হোসেন ভূঁইয়া (৩২), হবিগঞ্জের মোহনপুরের মৃত আমির হোসেনের ছেলে এস.আই হাসান উদ্দিন (৩২), ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার চামারুল্লা গ্রামের মৃত আতাউল করিমের ছেলে এএসআই আশেকে এলাহী (৪৩), সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার উক্তচন্দ্র গ্রামের অনিল কুমার দাসের ছেলে কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস (৩৮), হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার একডালা গ্রামের আব্দুন নুরের ছেলে কনস্টেবল হারুনুর রশিদ (৩২) ও সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বড়দেও (শমসেরনগর) গ্রামের ইছরাইল আলীর ছেলে আব্দুল্লাহ আল নোমান (২৮)।
আসামিদের মধ্যে আকবর হোসেন ভূঁইয়া, আশেকে এলাই, টিটু চন্দ্র ও হারুনুর রশিদ সরাসরি রায়হান হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। হাসান উদ্দিন ও আব্দুল্লাহ আল নোমান এস.আই আকবারকে পালিয়ে যেতে সহায়তাসহ আলামত নষ্ট করে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল তৎকালীন সিলেট মহানগর দায়রা জজ মো. আবদুর রহিম পাঁচ আসামির উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে চাঞ্চল্যকর রায়হান আহমদ হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। এর আগে ওই বছরের ১২ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের তারিখ নির্ধারণ থাকলেও সেটি পিছিয়ে নেওয়া হয়। অভিযোগ গঠনের পর মামলার বাদী নিহতের স্ত্রী তাহমিনা আক্তারের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে আদালত সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করেন। পরবর্তীতে নিহত রায়হানের গর্ভধারিণী মা সালমা বেগমসহ একে একে ৬১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত।
তবে গত বছর ৫৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের পর হঠাৎ করে আসামি কনস্টেবল হারুনের আইনজীবী পুরাতন ২৭ জন সাক্ষীকে নতুন করে পুনরায় জেরা করার আবেদন করেন। বাদীপক্ষ এই আবেদনের বিরোধিতা করেন। বিরোধিতা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি এ্যাডভোকেট নওশাদ আহমদ চৌধুরীও। ওই সময় পিপি বলেন- এভাবে পুরাতন সাক্ষীকে নতুন করে জেরা করা হলে মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হবে।
উভয়পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে আদালত পুরাতন ৭ সাক্ষীকে নতুন করে জেরা করার অনুমতি দেন। ওই সাক্ষীদের পুনরায় জেরা করা হয়। পরবর্তীতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ডকারী ম্যাজিস্ট্রেট, ময়না তদন্তকারী ডাক্তার ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
ঘটনার প্রায় সাড়ে ৪ বছরের মাথায় অবশেষে মামলাটির প্রথম আরগুমেন্ট অনুষ্ঠিত হবে আজ।
সোমবার রাতে রায়হান আহমদের মা সালমা বেগম কওমি কণ্ঠকে বলেন- ‘আমরা আর মামলার দীর্ঘসূত্রিতা চাই না। যত দ্রুত সম্ভব মামলাটির কার্যক্রম শেষ করে রায় ঘোষণার জোর দাবি জানাচ্ছি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অরাজনৈতিক সরকারপ্রধানের সময়ে যদি সুবিচার না পাই তবে আর কখন পাবো?’
সালমা বেগম আরও বলেন- ‘জানতে পেরেছি, প্রধান আসামি আকবর নাকি ৫ আগস্টের পরে একাধিকবার জামিন আবেদন করেছে। এখন সে জামিনে মুক্ত হলেই হয়তো পালিয়ে যাবে, নতুবা আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি করবে। তাই বিজ্ঞ আদালতের কাছে একান্ত মিনতি- আমার ছেলের প্রধান খুনিকে যেনো কোনো অবস্থাতেই জামিন না দেওয়া হয়।’