কওমি কণ্ঠ রিপোর্টার :
সিলেটের ইলিয়াস আলী। ছিলেন বিএনপির শক্তিধর নেতা। বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রামধানা গ্রামে। ২০১২ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম হন। পেরিয়ে গেছে একে একে ১৩টি বছর। এখনো অমীমাংসতি রয়ে গেছে বিএনপির জনপ্রিয় এই নেতার নিখোঁজের বিষয়টি।
সরকার, প্রশাসন কিংবা পরিবার- কারো পক্ষ থেকেই এখন পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে কিছু জানানো হচ্ছে না। তবে চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর ইলিয়াস আলী সম্পর্কে মিলেছে অনেক তথ্য। এসব তথ্যের ভিত্তিতে বেশিরভাগ মানুষের ধারণা- ইলিয়াস আলীকে গুম করার পরপরই হত্যা করা হয়েছে।
এমন তথ্যও দিয়েছেন ৫ আগস্টের পর রিমান্ডে নেওয়া ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান। জিয়ার কাছে গোয়েন্দা পুলিশের ইলিয়াস আলীর বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে প্রশ্ন ছিল- ‘ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার পর তিনি আপনাকে ফোনে বলেছিলেন, ইলিয়াসকে ছেড়ে দাও। আপনি ওই সময় বলেছিলেন, ‘ইলিয়াস আলীকে কিছুক্ষণ আগে শেষ করে দেওয়া হয়েছে।’
এ প্রশ্নের জবাবে নীরব থাকেন জিয়া।
এছাড়া হাসিনার পতনের পর এক র্যাব সদস্য ভাচ্যুয়াল মাধ্যম ফেসবুকে ভিডিও-বার্তায় ইলিয়াস আলীকে গুমের পর মেরে ফেলার তথ্য প্রকাশ করেন। ওই সদস্যের দাবি- তিনি ওই সময় র্যাবে চাকরিরত ছিলেন।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে ঢাকার নিজ বাসায় ফেরার পথে রাজধানীর মহাখালী থেকে গাড়ী চালক আনছার আলীসহ নিখোঁজ হন সিলেট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, বিএনপির সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সিলেট জেলা সভাপতি এম ইলিয়াস আলী । ওইদিন মধ্যরাতে মহাখালী এলাকা থেকে ইলিয়াস আলীর ব্যবহৃত গাড়ীটি উদ্ধার হলেও সন্ধান মেলেনি তাদের দুজনের ।
এই দীর্ঘ ১৩ বছরেও বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর গুম রহস্য উদঘাটিত হয়নি। ছেলে ফেরার প্রতীক্ষায় আজো প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন ইলিয়াস আলীর বৃদ্ধা মা সূর্যবান বিবি, সহধর্মিণী তাহসিনা রুশদীর লুনা ও তার ছেলে মেয়েরা। ইলিয়াস আলীর সাথে তার গাড়ি চালক আনসার আলীরও খোঁজ মেলেনি এখন পর্যন্ত।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজের পর তাকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে দেশব্যাপী গড়ে উঠে কঠোর আন্দোলন। আন্দোলন করতে গিয়ে ইলিয়াসের নির্বাচনী এলাকা বিশ্বনাথে প্রাণ হারান তিনজন। টানা কর্মসূচি পালন করেছিল কেন্দ্রীয় বিএনপিও। স্বামীকে উদ্ধারের আবেদন জানাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন ইলিয়াস পত্নী তাহসিনা রুশদীর লুনাও। গুমের দুই দিন পর তার স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন।
তিনি সেসময় অভিযোগ করেন- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবৈধভাবে তার স্বামীকে আটক করেছিল। তখন দলের নেতারাও একই অভিযোগ তুলেছিলেন। ইলিয়াস আলীকে আদালতে হাজির করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশ চেয়েছিলেন ইলিয়াস পত্নী লুনা। তার রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ১০ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা চেয়ে রুল জারি করে বলেছিলেন, ইলিয়াস আলীকে অবৈধভাবে আটক করা হয়নি এই মর্মে সন্তুষ্ঠ হওয়ার জন্যে কেন তাকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হবে না।
পরবর্তীতে আবেদনকারী বা সরকার রিট আবেদনের শুনানির বিষয়ে কোনো উদ্যোগ আজো পরিলক্ষিত হয়নি।
এ বিষয়ে ইলিয়াসপত্নী লুনা সংবাদমাধ্যমকে বলেন- এক এক করে ১৩টি বছর হয়ে গেলো ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হলো। আমাদের চোখে যতক্ষণ জল আছে ততক্ষণ শুধু প্রিয়জনের অপেক্ষায় অশ্রুবিসর্জন করবো। সরকারের দ্বারস্থ হয়েছি। কিন্তু, কোনো ফল পাইনি। সরকার ইলিয়াস আলীর সন্ধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা আল্লাহর আদালতেই বিচার দিলাম। জনতার সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ইলিয়াস রহস্যের উদ্ঘাটন হবে বলে তার আশা।
সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন- ‘সিলেটবাসীর প্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলীকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারই গুম করে। আমরা আমাদের নেতার সন্ধান চাই।
ইলিয়াস আলীর সন্ধানের দাবিতে বিএনপি আজ বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) দুটি কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
এদিকে, চব্বিশের গণঅভুত্থ্যানে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ‘আয়নাঘর’ নামক বন্দিশালা থেকে অনেকেই ছাড়া পান, যারা গত ১৫ বছরে গুম হন। ওই সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে রটে ‘আয়নাঘরে’ পাওয়া গেছে বিএনপির তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীকে। পরে অবশ্য জানা যায়, ইলিয়াস আলীকে গুমের পর পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সিলেট অঞ্চলে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা এম ইলিয়াস আলীকে গুম করার পর হত্যা করে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের নেতৃত্বে একটি ‘কিলিং স্কোয়াড’। হত্যার পর খুনিচক্র ইলিয়াস আলীর লাশ যমুনা নদীতে ফেলে দেয়। এই চাঞ্চল্যকর গুম ও হত্যার নির্দেশদাতা ছিলেন খোদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিতে র্যাব সদস্য সার্জেন্ট তাহেরুল ইসলাম ইলিয়াস আলীকে অপহরণের পর লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য দেন।
৫ আগস্টের পর এ নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক আমার দেশ। সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানের করা সেই প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর ইলিয়াস আলী গুম ও হত্যার আদিঅন্ত তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ- ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিতে তাহেরুল বলেন, জিয়াউল আহসানের নির্দেশে ঘটনার রাতে শেরাটন হোটেল থেকে তিনি ইলিয়াস আলীকে অনুসরণ করেন।
মহাখালী পৌঁছার পর জিয়াউল আহসান নিজেই আরেকটি টিম নিয়ে ইলিয়াস আলীর গাড়ি অনুসরণ করেন। ইলিয়াস আলীর গাড়ি বনানীর ২ নং সড়কের বাসার সামনে পৌঁছার আগেই বনানীর সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে থেকে তাকে তুলে নেওয়া হয়। ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তার ড্রাইভার আনসারকেও অপহরণ করা হয়। গাড়িটি জলখাবার হোটেলের সামনে দিয়ে বনানীর ২ নম্বর সড়কে ঢোকার পরে এই অপহরণের ঘটনা ঘটে।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র আরও জানায়, ইলিয়াসকে হত্যা ছাড়াও র্যাবের জিয়াউল আহসানের কিলিং স্কোয়াডের এক সদস্য একদিনে ১১ জন এবং আরেক সদস্য ১৩ জনকে খুন করেছিল। উল্লেখ্য, জিয়াউল আহসান তখন র্যাবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি জেলে আটক রয়েছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও গুম তদন্ত কমিশন সূত্রে আরও জানা গেছে, ইলিয়াস আলীকে অপহরণের সঙ্গে জড়িত দুজন সেনাসদস্য বর্তমানে সেনাবাহিনীতে রয়েছেন। এরা হলেন— ওয়ারেন্ট অফিসার জিয়া ও ইমরুল। জিয়াউল আহসানের রানার হিসেবে গুম ও খুন মিশনের হুকুম তারা তামিল করতেন। খুনিচক্রের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর গুম তদন্ত কমিশন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিমের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী এ দুই সদস্যকে ক্লোজড এবং অন্তরীণ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল সন্ধ্যার পর দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ইলিয়াস আলী সভা করেন তৎকালীন শেরাটন হোটেলে (বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল)। সভা শেষ করে রাত ১১টায় তিনি বের হন এবং গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিলেন। অপহরণের লক্ষ্যে জিয়াউলের নির্দেশে শেরাটন থেকেই অনুসরণ করছিলেন র্যাবের সদস্য সার্জেন্ট তাহেরুল ইসলাম। পরবর্তীতে তাকে চিহ্নিত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিম। তাকে তদন্ত কমিটিতে আনা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৬৪ ধারায় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, আমার দায়িত্ব ছিল শেরাটন থেকে অনুসরণ এবং বেতার বার্তায় গতিপথ জিয়াউল স্যারকে জানানো। নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি ইলিয়াস আলীর গাড়ি অনুসরণ এবং প্রতিটি মুহূর্তে গাড়ির গতিপথ জিয়াকে অবহিত করা। মহাখালী পৌঁছার পর ইলিয়াস আলীর গাড়ি সরাসরি অনুসরণ শুরু করেন জিয়ার টিম।
মহাখালী জলখাবার হোটেলের অদূরে বনানীর ২ নম্বর সড়কে গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে থামানোর পর ড্রাইভার আনসারসহ ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করে এই টিমের সদস্যরা। এরপরই জিয়া তাহেরুলকে বলেন, ‘তোমার ডিউটি শেষ, চলে যাও।’ নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব শেষে তিনি ফিরে যান। জিয়ার টিম ইলিয়াস আলীকে নিয়ে যাওয়ার পর কী হয়েছে সেটা তিনি বলতে পারবেন না। ’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইলিয়াস আলীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছিল। হত্যার পর তৎকালীন র্যাব কর্মকর্তা এবং পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হওয়া জিয়াউল আহসান অফিসে ফিরে স্বস্তি ও আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আজ বড় একটি অপারেশনে সাকসেসফুল হলাম। শেষ করে তাকে যমুনায় ফেলে দিয়ে এসেছি।’
জিয়া এ কথাও বলেন যে, ইলিয়াস আলী অপারেশনের কথা ঊর্ধ্বতনকে জানিয়েছি। ঊর্ধ্বতন বলতে তিনি মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকি কিংবা শেখ হাসিনাকে বুঝিয়েছেন বলে সূত্রের ধারণা। যাদের সামনে এই কথা জিয়াউল আহসান বলেছিলেন, তাদেরকেও চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিম।
গুম তদন্ত কমিশন সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার নির্দেশেই ইলিয়াস আলীকে গুম এবং খুন করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে এসএসএফ-এর মহাপরিচালক ছিলেন লে. জেনারেল চৌধুরী হাসান সওরাওয়ার্দী। তার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ডিজিএফআইর তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়ে ইলিয়াস আলীকে গুম করার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। অথচ পরবর্তী সময়ে ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে ডেকে এনে নাটকও করেছিলেন।
পুরাতন শাড়ি পরে জড়িয়ে ধরেছিলেন ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও কন্যাকে। এ সময় ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে অপহরণ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধের জের হিসেবে এটা করা হয়েছে বলে ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে অবহিত করেছিলেন শেখ হাসিনা।