সুনামগঞ্জ সীমান্তের একটি সুড়ঙ্গে ঢুকে যা করা হয়

কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :

৫০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩ ফুট প্রস্থের র‍্যাটহোল (পরিত্যক্ত সুড়ঙ্গ)। কখনো হামাগুড়ি, কখনো নুয়ে হেঁটে র‍্যাটহোলে ঢুকে গাঁইতি, শাবল, বেলচা দিয়ে টুকরো টুকরো কয়লা তুলে বস্তায় ভরে নিয়ে আসেন শ্রমিকেরা। ঝুঁকি নিয়ে এভাবে কয়লা সংগ্রহের সময় ঘটে দুর্ঘটনা। সীমান্তের ওপার থেকে কয়লা আনতে গিয়ে সরকারি হিসাবেই গত এক বছরে চারজন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন অনেকে।

ভারতের অভ্যন্তরে কাজ করতে যাওয়া কয়েক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ভারতীয় এসব র‍্যাটহোলে সুনামগঞ্জ সীমান্ত এলাকার কমপক্ষে ৮০০ শ্রমিক কাজ করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিজিবির টহল ও নজরদারি এড়িয়ে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে র‍্যাটহোলে কয়লা আনতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন সীমান্তবর্তী এলাকার নিম্ন-আয়ের মানুষ। মজুরি কম হওয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজে লাগাচ্ছেন মুনাফালোভী ভারতীয় র‍্যাটহোল পরিচালনাকারীরা।

স্থানীয়রা বলছেন, কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় ঝুঁকি নিচ্ছেন অভাবী মানুষেরা। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী কয়েকটি এলাকায় এর প্রবণতা বেশি। উপজেলার উত্তর বড়দল ও শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের ট্যাকেরঘাট, লালঘাট, লাকমা, বাগলী, রজনীলাইন, চাঁনপুরসহ প্রায় ২০ গ্রামের নিম্ন-আয়ের মানুষ এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হচ্ছেন। উঁচু-নিচু সরু গর্তের অন্ধকারাচ্ছন্ন টানেলে প্রবেশের পর দেয়াল ধস, শ্বাসকষ্ট, দিক বিভ্রান্তি ও প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বিজিবি বলছে, অনুপ্রবেশ বন্ধ ও অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুরোধে বিজিবি টহল কৌশলে পরিবর্তন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

জানা গেছে, ভারতের মেঘালয়ের পরিত্যক্ত কয়লাখনিতে এসব বিপজ্জনক র‍্যাটহোলের সংখ্যা বেশি। সঞ্চিত কয়লা সংগ্রহের পর খনি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘদিনের পরিত্যক্ত খনিতে তৈরি হয় র‍্যাটহোল বা ইঁদুরের গর্ত। এসব র‍্যাটহোল থেকে একজন শ্রমিক দিনে সর্বোচ্চ দুই বস্তা কয়লা সংগ্রহ করতে পারেন। প্রতি বস্তা কয়লা বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়। মেঘালয় ছাড়াও নোকলা, কুলাংসহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত র‍্যাটহোলে বাংলাদেশিরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শ্রমিকেরা এসব এলাকায় যান।

তাহিরপুরের উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের লাকমা গ্রামের বাসিন্দা নুর মিয়া। মা, স্ত্রী-সন্তানসহ সাতজনের সংসার তাঁর। এলাকায় কোনো কাজ না থাকায় চলতি বছরের ১ মে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মেঘালয়ের র‍্যাটহোল থেকে কয়লা আনতে যান তিনি। দুদিন পর স্বজনেরা জানতে পারেন, নুর মিয়া মাটিচাপায় মারা গেছেন। পরে ৩ মে নুর মিয়ার লাশ পান স্বজনেরা।

কথা হলে নুর মিয়ার মা কমলা বেগম বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে নুর মিয়া। তাঁর আয় দিয়ে সংসার চলত। পাহাড়ে কাজে গিয়ে মারা গেছে। এখন খেয়ে না খেয়ে কোনো রকম দিন পার করছি।’

নুর মিয়ার স্ত্রী মাফিয়া বেগম বললেন, ‘এলাকায় কোনো কাজ নেই। কাজের উদ্দেশ্যে পাহাড়ে যাওয়া। সেখানে মাটিচাপা পড়ে মারা গেছেন। এরপর থেকে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ রয়েছে।’ একই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল খালেকের ছেলে নুরুল হক প্রায় দুই বছর আগে র‍্যাটহোল থেকে কয়লা আনতে গিয়ে মাটিচাপায় মারা যান।

নুরুলের বড় ভাই আতাউল্লাহ বলেন, ‘এলাকায় কোনো কাজ নেই। অভাবের কারণে পাহাড়ে যেতে হয়। সংসার চালাতেই নুরুল পাহাড়ে গিয়েছিল। সুড়ঙ্গের ভেতর ঢোকার পর মাটিচাপায় মারা যায়।’

লাকমা গ্রামের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা ব্যবসায়ী হাসান আলী বলেন, ‘সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কয়লা আনতে কেউ ইচ্ছে করে যায় না। এলাকায় কোনো কাজের ব্যবস্থা নেই। মানুষ চলবে কী করে। অনেকেই শহরমুখী হচ্ছেন। যাঁরা শহরে যাচ্ছেন না, তাঁরা এই কাজের সঙ্গে জড়িত হচ্ছেন।’

এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ ২৮ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এ কে এম জাকারিয়া কাদির বলেন, ‘কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় জীবনের ঝুঁকি জেনেও স্থানীয়রা বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কয়লা আনার চেষ্টা করে। এতে অনেকে বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন। এটি রোধ করতে কিছু স্পর্শকাতর এলাকায় টহল বাড়ানোসহ সীমান্তবর্তী এলাকাবাসীর বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে স্থানীয়দের মধ্যে মাছ ধরার বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করেছি।’


(মূল রিপোর্ট : আজকের পত্রিকা)