রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি : রেশমা উদ্ধার ছিল নাটক!

কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :

সাভারে রানা প্লাজা ধসের এক যুগ পূর্ণ হলো আজ। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধস বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্পদুর্ঘটনার একটি। ওই দুর্ঘটনায় রানা প্লাজার কয়েকটি ফ্লোর ভেঙে পড়ে। প্রতিটি ফ্লোরেই ছিল গার্মেন্ট কারখানা। এতে এক হাজার ১৩৮ পোশাক শ্রমিকের করুণ মৃত্যু ঘটে; পঙ্গুত্ববরণ করেন এক হাজার ১৬৯ শ্রমিক। আর আহত হন প্রায় দুই সহস্রাধিক শ্রমিক।

সেদিনের সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় পুরো বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল। আওয়ামী-সংশ্লিষ্টতার সুবাদে কোনোরকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই ভবন নির্মাণের অভিযোগ ওঠে। হতাহত ও নিখোঁজদের ক্ষতিপূরণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম হয়। আহতদের দাবি, তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি ও পরিপূর্ণ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হোক।

রেশমা উদ্ধার ছিল সাজানো নাটক :
ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৭ দিন পর পোশাককর্মী রেশমা উদ্ধারের ঘটনাটি ছিল সাজানো নাটক। ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায় নেওয়ায় এ নিয়ে মুখ খুলেছেন ধসেপড়া কারখানার আহত শ্রমিকরা। রেশমা উদ্ধারকে নাটক হিসেবে দেখছেন খোদ রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ভবনে চাপা পড়া এবং পরবর্তীতে উদ্ধার হওয়া শ্রমিকরা।

তাদের দাবি, ধ্বংসস্তূপের নিচে রেশমার জীবিত থাকার বিষয়টি একেবারেই হাস্যকর। উদ্ধারের সময় তাকে বেশ প্রাণবন্ত দেখা গেছে। গায়ে নতুন জামা পরিহিত ছিল। তাকে উদ্ধার করে সাভার সিএমএইচে নেওয়ার পরপরই সেখানে সেনাবাহিনীর বিশেষ হেলিকপ্টারযোগে পৌঁছান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে রেশমা উদ্ধার নিয়ে একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সে সময় এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের ট্যাবলয়েড ‘মিরর’-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়- রেশমা ১৭ দিন ধ্বংসস্তূপে চাপা থাকার পর উদ্ধার একটি নাটক ছিল।

চতুর্থ তলায় ফ্যান্টম অ্যাপারেলস কারখানায় সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতেন ঝিনাইদহ জেলার বাসিন্দা জুয়েল রানা। ভবন ধসের তিন দিন পর উদ্ধার হন তিনি। এ ঘটনায় তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেছে। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। তিনি বলেন, আমি তিন দিন ধ্বংসস্তূপের ভেতরে ছিলাম। খাবার পানি, অক্সিজেন, আলো-বাতাস কিছুই ছিল না। ছিল মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করা মানুষের আহাজারি। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে এই বুঝি মরে গেলাম। আমাকে অচেতন উদ্ধার করা হয়। তিনি মনে করেন, এমন পরিবেশে রেশমা ১৭ দিন ধ্বংসস্তূপে চাপা থাকার পর উদ্ধার হাস্যকর ও নাটক।

একদিন পর উদ্ধার হওয়া শ্রমিক মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার দুর্গাপুরের বাসিন্দা মাহমুদুল হাসান হৃদয় বলেন, রেশমার উদ্ধার ছিল স্বৈরাচারী সরকারের নাটক। তিনি ভবনের ৮ তলায় নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেড কারখানায় কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দুর্ঘটনায় ২২ ঘণ্টা ভবনের ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ায় মেরুদণ্ড ও বুকের পাঁজর ভেঙে গেছে। মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। তার চেহারা অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, রেশমা উদ্ধার নাটকের সময় তার চেহারায় কোনো পরিবর্তন ছিল না।

অনুরূপ মনে করেন একদিন পর উদ্ধার হওয়া শ্রমিক ধামরাইয়ের সোয়াপুর ইউনিয়নের ভাদালিয়া গ্রামের বাসিন্দা শিউলী বেগম, চতুর্থ তলায় ফ্যান্টম অ্যাপারেলসের মেইনটেন্যান্স কর্মকর্তা এবং ধ্বংসংস্তূপ থেকে একদিন পর উদ্ধার হওয়া সৈয়দ শাহাদাৎ হোসেন সোহানসহ আরো অনেকে।

রেবেকা আজ নিজেই অচল :
এক সময় শ্রম দিয়ে পোশাকশিল্পকে বাঁচিয়ে দেশের অর্থনীতি সচল রাখলেও আজ নিজেই চলতে পারেন না রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দুই পা হারানো দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদীপুর ইউনিয়নের বারাইহাট এলাকার রেবেকা খাতুন (৩৫)। তিনি ওই গ্রামের রাজমিস্ত্রি মোস্তাফিজার রহমানের স্ত্রী।

দুই পা হারিয়ে কর্মহীন হয়ে বাড়িতে বসেই সময় কাটছে তার। দুর্ঘটনার পর অনেক অনিয়মের মধ্যে কিছু টাকা পেলেও এ পর্যন্ত আটবার করাতে হয়েছে কাটা পায়ের অপারেশন। আবারও অপারেশনের তাগিদ দিয়েছেন ডাক্তার। দুর্ঘটনার পর নিখোঁজ মা ও দাদির লাশটুকুও পাননি রেবেকা। সেদিনের দুর্ঘটনায় নিখোঁজ হন তার মা চান বানু, দাদি কোহিনুর বেওয়া। তালিকায় নাম না থাকায় ক্ষতিপূরণ পায়নি রেবেকার মা ও দাদির পরিবার।

সেই ঘটনা বর্ণনা করে রেবেকা বলেন, ২৩ এপ্রিল রানা প্লাজায় ফাটল দেখা দিলে বিকাল ৪টায় সবাইকে ছুটি দিয়ে দেয় গার্মেন্ট কর্তৃপক্ষ। পরদিন বিল্ডিং ফাটলের কারণে কাজে যোগ দিতে না চাইলে বেতন-ভাতাসহ ওভারটাইমের টাকা বন্ধ করে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হয়। চাকরি হারানোর ভয়ে অন্যান্য শ্রমিকের মতো রেবেকাও সেদিন বাধ্য হয়ে কাজে যোগ দেন। ফলে বরণ করেন এমন পরিণতি।

অনিয়মের কথা তুলে ধরে রেবেকা খাতুন বলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এক পা হারানো ব্যক্তিরা ১০ লাখ ও দুই পা হারানো ব্যক্তিরা ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৫ লাখ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু সে সময় ১৫ লাখ টাকার স্থলে তথ্য ভুলের কারণে পেয়েছি ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। সেই সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ প্রতি মাসে ৯ হাজার ১০০ টাকা করে পাচ্ছি।

সেদিনের দুর্ঘটনায় নিখোঁজ হন উপজেলার কাজিহাল ইউনিয়নের ডাঙ্গা গ্রামের আতাউর রহমানের স্ত্রী গুলশানে জান্নাত (শাবানা)। তখন তার বয়স ছিল ২৭ বছর। গুলশানে জান্নাত শাবানার স্বামী আতাউর রহমান জানান, শাবানা রানা প্লাজার ষষ্ঠতলায় সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করত।

প্রতিদিনের মতো শাবানা ওইদিন রানা প্লাজায় কাজ করতে যায়। এরপর ঘটে সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাইনি। তবে নিখোঁজ তালিকায় শাবানার নাম ছিল। সেই সূত্র ধরে ওই সময় ১৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছি।

মূল রিপোর্ট : আমার দেশ