- চলে যাওয়ার এক যুগ
মো. রেজাউল হক ডালিম
বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতি এবং ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষার আন্দোলনে অন্যতম পুরোধা মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ইন্তেকালের এক যুগ পূর্ণ হলো। ২০১২ সালের এ দিনে মহান এই ব্যক্তিত্ব পরপারে পাড়ি জমান।
বিশ্লেষকরা বলছেন- দেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে একজন মুফতি আমিনীর বড়ই প্রয়োজন ছিরো। তাঁর চলে যাওয়ার এক যুগ বছর পার হয়ে গেলেও তিনি এখনও এ দেশের ধর্মীয় পরিমণ্ডল এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর রাত ১২টা ১৫ মিনিটে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান মুফতি আমিনী। ওই রাতে এশার নামাজের পর দলের নেতা কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন মুফতি আমিনী। রাত সোয়া ৯টার দিকে হঠাৎ করেই তিনি বুকে ব্যাথা অনুভব করেন। তখন তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যথা না কমায় রাত সোয়া ১১টার দিকে তাকে নিয়ে ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ো যাওয়া হলে সেখানে এক ঘণ্টা চিকিৎসাধীন থাকার পর সোয়া ১২টার দিকে তিনি মহান আল্লাহর সান্যিধ্যে চলে যান। ১২ ডিসেম্বর বিকেল ৩টা জানাযার নামাজ শেষে ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।
মৃত্যুকালে ফজলুল হক আমিনীর বয়স হয়েছিলো ৬৯ বছর। তিনি সেসময় স্ত্রী ২ ছেলে ৪ মেয়ে রেখে যান।
১৯৪৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন মুফতি আমিনী। তিনি বিএনপি নেতৃত্বাধীন বর্তমান ১৮ দলীয় জোটের শরিক দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন। রাজধানীর লালবাগ জামেয়া কোরআনিয়া এবং বড় কাটারা আশরাফুল উলুম মাদরাসাসহ বেশ কয়েকটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন তিনি।
মুফতি আমিনীর বর্ণাঢ্য জীবন পর্যালোচান করে জানা যায়- হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর হাত ধরে তিনি রাজনীতির ময়দানে আগমন করেন। তার জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তার রাজনীতি ও আন্দোলন তিনটি ধাপে বিভক্ত। প্রথম ধাপ ১৯৮১ থেকে ৮৭ সালে হযরত হাফেজ্জীর ইন্তেকাল পর্যন্ত। এ সময়টায় তিনি তার পাওয়ারফুল কণ্ঠ ও স্বভাবসুলভ মেধায় দ্যুতি ছড়ালেও তিনি মূলত শিক্ষানবিশ ছিলেন। প্রচলিত রাজনীতির ধরন, চেনা-অচেনা ওলিগলি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে ওঠা-বসার মধ্য দিয়ে শিখেছেন। সমৃদ্ধ করেছেন অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার।
১৯৮৭ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন, কমিটি ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং মানুষকে ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী রাজনীতির সাথে পরিচয় করাতে করাতে তিনি একজন যোগ্য ও অনন্য নেতায় পরিণত হয়েছেন। বাবরী মসজিদ অভিমুখে লংমার্চ, তসলিমাবিরোধী আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক আন্দোলনগুলোতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অন্যদিকে উলামা কমিটি, জমিয়তুল আনসার, সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ, ইসলামী মোর্চার মতো বিভিন্ন কমিটি ও শক্তিশালী সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তার অচিন্তনীয় সাংগঠনিক দক্ষতার প্রকাশ ঘটেছে এবং তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন দেশসেরা সংগঠক হিসেবে ।
১৯৯৭ সালে চারদলীয় জোট গঠনের মধ্য দিয়ে একজন জাতীয় নেতা হিসেবে তার পথচলা শুরু। এরপর কেবল এগিয়ে গিয়েছেন। নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছেন। ফতোয়াবিরোধী ঐতিহাসিক আন্দোলন এবং সর্বশেষ নারীনীতি ও শিক্ষানীতির প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের নেতা হিসেবে নিজেকে পাহাড়সম উচ্চতায় উন্নীত করেছেন ।
ইসলামি রাজনীতিবিদ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলেন- ‘মুফতি আমিনী রহ.-এর কথা ভাবলে সমুদ্রের কথা মনে হয়। আমরা তাল হারিয়ে ফেলি, এলোমেলো হয়ে যাই। মহান সেই রাজনীতিবিদ এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। সময় বদলেছে, কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। তিনি যেভাবে কাজ করেছেন, ইসলামের স্বপক্ষে যেভাবে কথা বলেছেন, তা আজও আদর্শ হয়ে আছে। কিন্তু সত্য করে বললে বলতে হবে, তার মতো অবস্থানে এখন দ্বিতীয় আর কাউকে দেখি না।’
তারা আরও বলেন, ‘মুফতি আমিনীর অন্যতম একটি গুণ হলো, তিনি ছিলেন আপোষহীন। কখনও তিনি আপোষে যেতেন না। হয়ত নিজে থেকে পিছিয়ে আসতেন বা চুপ থাকতেন, কিন্তু আপোষ করতেন না। মুফতি আমিনী রহ. যে আন্দোলনই করতেন, তার পরিণতি সম্পর্কে তিনি সচেতন থাকতেন। পরিণতি মাথায় রেখেই তিনি আন্দোলন পরিচালনা করতেন। দেখা গেছে- তিনি গরম গরম বক্তৃতা দিচ্ছেন, আবেগী করে তুলছেন সবাইকে। কিন্তু তার মধ্যে তখনও পরিণতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল। তাঁর সময়ে ফতোয়া আন্দোলনে ৬ শহীদের ঘটনাও ঘটেছে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন- ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে একজন মুফতি আমিনীর বড়ই প্রয়োজন ছিলো। প্রজ্ঞা ও ইসলামি রাজনীতির অভিজ্ঞতার বিশাল ভান্ডার ইসলামি সব দলকে এক কাতারে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক হতো।
প্রখ্যাত আলেম কবি ও বিশ্লেষক মুসা আল হাফিজ দুই বছর আগে বলেছিলেন- একটা জাতি বা গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে থাকা বা প্রতিষ্ঠিত থাকার মৌলিক উপাদানগুলোর একটি হচ্ছে ওই জাতি তাঁর জাতিগত শত্রু কারা এবং কারা তাদের মিত্র, তা চিনতে পারা। মুফতি আমিনী রহমতুল্লাহ আলায়হি ফ্যাসিবাদ এবং রাজনৈতিক স্থবিরতার এই সময়ে তার জীবৎকালের মতোই সমান প্রাসঙ্গিক থাকবার প্রধানতম কারণ হচ্ছে, তিনি জাতিগত শত্রু এবং মিত্রদের চিনতে পারতেন। জাতিগত শত্রুদের সঙ্গে কখনোই আপোস করতেন না। লক্ষ্য ঠিক রাখার জায়গাটায় আমরা যেখানে আরও সচেতন হবার কথা, সেখানে দিনদিন আমরা আরও নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু মুফতি আমিনী ছিলেন লক্ষ্যের প্রতি অবিচল। একজন আমিনীর প্রাসঙ্গিকতা এই কারণেও এখনও গুরুত্বপূর্ণ।
মুফতি আমিনীর রাজনেতিকত দূরদর্শীতা সম্পর্কে গবেষক এই আলেম বলেন- রাজনীতির গতিপথ বুঝতেন মুফমি আমিনী, বুঝতেন সময়ের প্রয়োজন এবং চাহিদা। ‘হাওয়া বুঝে পাল খাটানো’র যে একটা প্রবণতা আছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনেকের মধ্যে, মুফতি আমিনী তেমন ছিলেন না। তিনি বাস্তবতার আলোকে এবং চাহিদার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। অনেকে বলেন, তিনি ‘গরম গরম বক্তব্য’ দিতেন। হ্যাঁ, তিনি দিতেন। কিন্তু সেটা অবাস্তব কোনো বক্তব্য হতো না। তিনি যখনই কোনো হুংকার দিয়েছেন, এই হুংকারকে যথাযথভাবে কাজেও লাগিয়েছেন। অবাস্তব কোনো হুংকার তিনি দেননি। আমি বলছি না- রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় তিনি কখনো ভুল করেননি। মানুষ হিসেবে ভুল করতেই পারেন। কিন্তু জেনে বুঝে কখনো ভুলের পথে পা বাড়াননি। ভুল করেছেন ভুলক্রমে।