কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :
কাস্টমস কর্মকর্তাদের ‘অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা চর্চা’র ফলে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। এ বিমানবন্দরে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ব্যাগেজ তল্লাশি থেকে বাদ যাচ্ছে না দেশি- প্রবাসী কোনো যাত্রীই।
অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মীদের বিমানবন্দরে অকারণে লাগেজ খোলাসহ যেকোনো হয়রানিমূলক কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দিলেও ওসমানী বিমানবন্দরে যেন এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রবাসীদের পাশাপাশি সিলেটের সচেতন মহলও।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন- বিমানবন্দরে অযথা যাত্রীদের লাগেজ তল্লাশি কেবল গণবিরোধীই নয়, প্রবাসী বিরোধীও।
গত ২১ এপ্রিল দুবাই থেকে আসা একটি ফ্লাইটের কয়েক যাত্ৰী ওসমানী বিমানবন্দরের গ্রীন চ্যানেলে হয়রানির শিকার হন। তাদের অভিযোগ, তার লাগেজ কেটে কে বা কারা সমস্ত মালামাল নিয়ে যায়। বিষয়টি সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে শুরু হয় তোলপাড়। ভিডিওতে যাত্রীদের সাথে সেখানে কর্মরত এক কর্মকর্তাকে তর্কে লিপ্ত হতে দেখা যায়। মঙ্গলবার সকালে সৌদিআরবের জেদ্দা থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে দেশে আসেন এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সিলেট জোনের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান খান রেজওয়ান। কাস্টমসের লোকজন স্ক্যানিংয়ের পর তাকে ব্যাগেজ খুলতে বলেন। তিনি কাস্টমসের লোকজনকে বুঝাতে চান যে, ব্যাগেজে তার বাচ্চাদের কিছু খাবার-দাবার ও খেজুর রয়েছে।
কিন্তু, ব্যাগেজ খুলতে অনড় তারা। বিমানবন্দরের একজন ঊর্ধ্বতন কাস্টমসের লোকজনকে তার (রেজওয়ান) পরিচয় দেবার পরও তারা তার সাথে বাগবিতন্ডায় লিপ্ত হয়।
এ প্রসঙ্গে আটাব সভাপতি বলেন, নিজের পরিচয় না দিয়েই সাধারণ যাত্রীবেশে তিনি গ্রীন চ্যানেল অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাস্টমস কর্মকর্তারা তার সাথে যে আচরণ করেছে-তা চরম অসৌজন্যমূলক।
তিনি বলেন, মূলত হজযাত্রীদের আবাসনসহ অন্যান্য কাজে কয়েক দফা তাকে সৌদি আরবে যেতে হয়েছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা তার ঘন ঘন সৌদি আরব যাত্রা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। তার সামনে আরো কয়েকজন প্রবাসী যাত্রীও ব্যাগেজ তল্লাশির শিকার হন।
এ প্রসঙ্গে আটাব সভাপতি আরও বলেন, ওসমানী বিমানবন্দরে কাস্টমস কর্তৃক এ ধরনের হয়রানি কারোরই কাম্য নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি দায়িত্বশীল সূত্র সেখানে কাস্টমসের সার্চ করার নামে যাত্রী হয়রানির বিষয়টি স্বীকার করেছে।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের দাবি- সব যাত্রীই সোনা নিয়ে বেরোচ্ছে। আর এটাই তাদের তল্লাশির মূল কারণ বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
২০২৪ সালের এয়ারপোর্ট ব্যাগেজ বিধিমালা অনুযায়ী, কোনও অপর্যটক যাত্রী কর্তৃক যুক্তিসঙ্গত পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য পরিধেয়, গৃহস্থালী বা অন্যান্য ব্যক্তিগত সামগ্রী-যার একক কোন আইটেমের ওজন ১৫ কেজির অধিক নয়, তা আনতে পারবেন। কিন্তু, কাস্টমস কর্মকর্তাদের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা চর্চার ফলে বিমানবন্দর যেন তাদের টার্গেট জোনে পরিণত হয়েছে। যার ভুক্তভোগী সাধারণ যাত্রীরা।
সিলেট জেলা বারের সাবেক সভাপতি, বিশিষ্ট আইনজীবী এমাদ উল্যাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন- সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কেবল কাগজে আন্তর্জাতিক, বাস্তবে এখানে আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা এখনো নিশ্চিত হয়নি। এ বিমানবন্দরে প্রবাসীবান্ধব সেবা নিশ্চিত করা-এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। এ বিমানবন্দরে লাগেজ টানা হেচঁড়া করা, লাগেজ কাটাছেঁড়া কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এ প্রসঙ্গে তিনি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরের উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানে প্রযুক্তির মাধ্যমে যাত্রীদের লাগেজ তল্লাশি করা হয়। কোন প্যাসেঞ্জারের যদি লাগেজ খোলারও প্রয়োজন হয়-তাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে সেটি খুলতে বলা হয়।
তিনি বলেন, ওসমানী বিমানবন্দরকে প্রবাসীবান্ধব করতে হলে সেখানে তল্লাশির আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে হবে।
ওসমানীতে সোনা চোরাচালানের অজুহাতে যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশি করা হয় এই মন্তব্য করে তিনি বলেন- অভিযোগ রয়েছে, এ ধরনের চোরাচালানের সাথে বড় ধরনের সিন্ডিকেটের পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন মহল জড়িত। কাস্টমস থেকে শুরু করে সিভিল এভিয়েশন ও এয়ারলাইন্স কর্মকর্তাদের-এ ধরনের চোরাচালানে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অনেক সময় মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। এর সাথে সাধারণ যাত্রীদের তেমন কোন সংশ্লিষ্টতা থাকে না । বিমানবন্দরে অযথা যাত্রীদের লাগেজ তল্লাশি কেবল গণবিরোধীই নয়, প্রবাসী বিরোধীও- যোগ করেন এই আইনজীবী।
যোগাযোগ করা হলে ওসমানী বিমানবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনারের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ইনজামাল উল হক জানান, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক যাত্রী গোলপ্যাকিং করে মালামাল দেশে নিয়ে আসে। বিষয়টি তাদের কাছে সন্দেহজনক। যাত্রীরা কাস্টমস কর্মকর্তাদের কো-অপারেট করতে চায় না। এ কারণে তারা অনেক সময় লাগেজ খুলে দেখতে চান। বিমানবন্দরে তারা প্রফেশনালি (পেশাদারিত্ব) লাগেজ তল্লাশির চেষ্টা চালান।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) জেদ্দা থেকে আসা ফ্লাইটে সিলেট আটাব-এর সভাপতি লাগেজ তল্লাশি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
লাগেজ খোলার বিষয়ে এনবিআরের নির্দেশনা :
গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মীদের বিমানবন্দরে অকারণে লাগেজ খোলাসহ যেকোনো হয়রানিমূলক কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। দেশের সব বিমানবন্দরে কাস্টমস বিভাগকে সম্প্রতি এই নির্দেশনা দেয় এনবিআর। এছাড়া দেশের সব বিমানবন্দরের কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রবাসীদের সহযোগিতা করারও নির্দেশ দেয়। নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, এয়ারপোর্টে আসার পর কয়েকবার লাগেজ খোলা, দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা, বেল্ট-মানিব্যাগ-জুতা-ল্যাপটপ- মোবাইলসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে চেক করার অভিযোগ আছে কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। অথচ বিদেশে স্ক্যানিং মেশিনের মাধ্যমেই যাবতীয় চেকিং শেষ করা হয়ে থাকে। প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে। দীর্ঘদিন ধরে বিমানবন্দরে ভোগান্তিমুক্ত পরিবেশ দাবি করছিলেন তারা। আদেশ জারির পর যদি প্রবাসীদের কোনো ধরনের হয়রানি করা হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও এনবিআরে নির্দেশনায় বলা হয়েছিল। এর আগে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মীদের বিমানবন্দরে অধিকতর সেবা দিতে অনুরোধ জানিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।
(মূল রিপোর্ট : সিলেটের ডাক)