কওমি কণ্ঠ রিপোর্টার :
চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঠেকাতে শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশ বাহিনী ছিলো বেপরোয়া। বিশেষ করে ঢাকার প্রায় সব থানার ওসি অবতীর্ণ হয়েছিলেন খুনির চরিত্রে। ফলে ৫ আগস্টে হাসিনার পলায়নের পরপরই তারা পড়েন জনরোষে। পালিয়ে যেতে হয় অনেককে।
তবে সে সময় বেপরোয়া থাকা ওসিদের বেশিরভাগই এখনও রয়েছেন বহাল তবিয়তে। এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুগান্তর পত্রিকা।
প্রতিবেদনটিতে প্রকাশ- জুলাই আন্দোলনের সেই রক্তাক্ত দিনগুলোতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে খুশি রাখতে ঢাকার ৫০ থানার ওসিরা ভয়ানক রকমের বেপরোয়া ছিলেন। ফ্যাসিস্টের দোসর হিসাবে তারা নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালায়। শত শত মায়ের বুক খালি করে। জুলাইয়ের রক্তের দাগ নিয়ে সেই ওসিদের অনেকেই এখনো বেশ ভালোভাবেই আছেন। পুলিশের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত আছেন। এর মধ্যে ৫ জন আছেন সিলেট বিভাগে পুলিশের বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার মাঝে।
জানা গেছে- আন্দোলন চলাকালীন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-এর ৫০ থানায় দায়িত্ব পালন করেছিলেন ৫৮ জন ওসি। কালো তালিকায় থাকা এই ৫৮ ওসির মধ্যে মাত্র ১০ জনকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। এই ১০ জনের মধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পলাতক আছেন চারজন। বাধ্যতামূলক অবসরে দেওয়া হয়েছে দুজনকে। আর সংযুক্ত আছেন একজন।
আর বাকিদের বহাল তবিয়তে বিভিন্ন স্থানে পোস্টিং করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২০২৪ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত তুরাগ থানায় ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করা শেখ সাদিক বতর্মানে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সিলেটে কর্মরত। বংশাল থানার তৎকালীন ওসি মইনুল ইসলাম আছেন সিলেট ডিআইজি রেঞ্জে। পল্টনের ওসি মনির হোসেন মোল্লা রয়েছেন সুনামগঞ্জ জেলাপুলিশে। ২০২৪ সালের ৩০ জুলাই থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত রামপুরা থানায় দায়িত্ব পালন করা ওসি রিজাউল হক আছেন সিলেট ট্রেনিং সেন্টারে। আর তেজগাঁওয়ের মোহাম্মদ মহসীন রয়েছেন সুনামগঞ্জ পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে।
এছাড়া আবু সাঈদ আল মামুন উত্তরখান থানার ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত। তিনি চট্টগ্রাম রেঞ্জ অফিসে স্বাভাবিক পদায়নে আছেন। ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট পর্যন্ত ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী শাহীনুর রহমান এখন লালমনিরহাট পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরত। বনানী থানার তৎকালীন ওসি কাজী শাহান হক আছেন রংপুর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। আমিনুল বাশার ২০২৪ সালের ২ এপ্রিল থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত দক্ষিণখান থানার ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এখন তিনি শিল্প পুলিশ চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করছেন।
হুমায়ুন কবির খিলক্ষেত থানার ওসি ছিলেন ২০২৪ সালের ২ এপ্রিল থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত। তিনি এখনো বহাল আছেন ট্যুরিস্ট পুলিশ হেড অফিসে। শেখ শাহানুর রহমান খিলক্ষেত থানার ওসি ছিলেন ২০২৪ সালের ২২ জুলাই থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত। তিনি খাগড়াছড়ি ট্রেনিং সেন্টারে নরমাল পোস্টিংয়ে আছেন। কোনো ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয়নি তাকে। বাড্ডা থানার তৎকালীন ওসি মোহাম্মদ ইয়াসীন গাজী আছেন কক্সবাজার এপিবিএনে। ইয়াসিন গাজীর পর বাড্ডা থানার ওসি হিসাবে দায়িত্ব পাওয়া মোহাম্মদ আবু ছালাম মিয়া এখন এপিবিএন খাগড়াছড়িতে কর্মরত। নিউ মার্কেট থানার তৎকালীন ওসি আমিনুল ইসলাম কর্মরত আছেন শিল্প পুলিশ গাজীপুরে। হাজারীবাগ থনার ওই সময়ের ওসি নূর মোহাম্মদ আছেন বান্দারবান জেলা পুলিশে। লালবাগ থানার তৎকালীন ওসি খন্দকার হেলাল উদ্দিন আছেন এপিবিএন-এ। চকবাজারের ওসি কাজী শাহীদুজ্জামান আছেন রংপুর জেলা পুলিশে।
শাহবাগের তৎকালীন ওসি মোস্তাজিরুর রহমান আছেন বরিশাল ট্রেনিং সেন্টারে। কলাবাগান থানার ওই সময়ের ওসি মফিজুল আলম এখন খাগড়াছড়ি ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরত। রমনা মডেল থানার উৎপল বড়ুয়া আছেন কুষ্টিয়া জেলা পুলিশে। ২০২৪ সালের ৩০ জুলাই থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত ধানমন্ডি থানার ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী এমরানুল হক স্বাভাবিক পদায়নে আছেন নোয়াখালী ট্রেনিং সেন্টারে। সূত্রাপুরের তৎকালীন ওসি মাসুদ আল খুলনা রেঞ্জে এরং কোতোয়ালির মাহফুজুর রহমান মিয়া নোয়াখালী পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরত। কামরাঙ্গীরচরের ওসি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম আছেন ট্যুরিস্ট পুলিশ সদর দপ্তরে। সাইফুল ইসলামের পর কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি হিসাবে দায়িত্ব পাওয়া শাকের মোহাম্মদ যুবায়ের এখন আছেন ময়মনসিংহ ট্রেনিং সেন্টারে।
২০২৪ সালের ২৬ জুলাই থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত বংশাল থানায় ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী এসএম আবু ফরহাদ আছেন কক্সবাজার ইন সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে। পিরোজপুর ইন সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে আছেন মতিঝিলের তৎকালীন ওসি আবুল কালাম। শাহজাহানপুরের সুজিত কামার সাহা নীলফামামী ট্রেনিং সেন্টার, খিলগাঁওয়ের সালাহ উদ্দীন মিয়া এপিবিএন-১৮, সবুজবাগের প্রলয় কুমার সাহা খুলনা ট্রেনিং সেন্টার এবং মুগদার আবু আনছার জামালপুর এখন ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরত।
রামপুরা থানায় ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ২৯ জুলাই পর্যন্ত ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন মশিউর রহমান। সেপ্টেম্বর থেকে পুলিশ একাডেমি সারদায় কর্মরত। ডেমরার মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম কর্মরত আছেন এপিবিএন খাগড়াছড়িতে। কদমতলীর কাজী আবুল কালাম খাগড়াছড়ি এপিবিএন, গেণ্ডারিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান ট্যুরিস্ট পুলিশ, শ্যামপুরের আতিকুর রহমান গাইবান্ধা এসপি অফিস, ওয়ারীর জানে আলম মুনশী এপিবিএন-১৪, রূপনগরের আব্দুল মজিদ বরিশাল ট্রেনিং সেন্টার এবং ভাষানটেকের নাসির উদ্দিন এপিবিএন-৫ ঢাকায় কর্মরত। শাহআলী থানার ওই সময়ের ওসি তারিকুজ্জামান রাজশাহী ট্রেনিং সেন্টারে, আদাবরের মাহাবুবর রহমান গাইবান্ধা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার এবং কাফরুলের ফারুকুল আলম শিল্প পুলিশ খুলনায় কর্মরত।
দারুস সালাম থানায় ২০২৪ সালের ৯ জুন থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী সিদ্দিকুর রহমান ট্যুরিস্ট পুলিশ ঢাকা অঞ্চলে এবং একই থানায় ২০২৪ সালের ২৩ জুলাই থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী কামরুল ইসলাম এপিবিএন বরিশালে কর্মরত। হাতিরঝিল থানার তৎকালীন ওসি শাহ মো. আওলাদ হোসেন ঢাকার বাইরে একটি ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরত আছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, মোহাম্মদ ইয়াসির আরাফাত খান ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট পর্যন্ত মতিঝিল থানার ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ইতোমধ্যে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১ আগস্ট পর্যন্ত উত্তরা পূর্ব থানার ওসি ছিলেন মজিবুর রহমান। হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে তিনি এখন জেলে আছেন। ২০২৪ সালের ১ আগস্ট থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত উত্তরা পূর্ব থানার ওসি ছিলেন শাহ আলম। ছাত্র-জনতা হত্যার মামলায় জানুয়ারিতে তাকে গ্রেফতার করে ওই থানায় নেওয়া হয়। পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় তিনি থানা থেকে পালিয়ে যান। ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত তুরাগ থানার ওসি হিসাবে দায়িত্বপালনকারী আনিচুর রহমান মোল্লাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার।
কাজী মাইনুল ইসলাম ২০২৩ সালের১৫ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট পর্যন্ত ভাটারা থানার দায়িত্বে ছিলেন। পরে তাকে নেত্রকোনা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে বদলি করা হয়। সেখান থেকে চলে যান আত্মগোপনে। পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম গুলশানের ওসি ছিলেন ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট পর্যন্ত। পরে তাকে খাগড়াছড়ি বিশেষায়িত ট্রেনিং সেন্টারে বদলি করা হয়। সেখান থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০২৪ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের ১৮ আগস্ট পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী থানার ওসি ছিলেন আবুল হাসান। তিনি এখন জেলে আছেন। মিরপুর মডেল থানার তৎকালীন ওসি মুন্সী ছাব্বীর আহম্মদ এবং পল্লবীর অপূর্ব হাসান পলাতক অবস্থায় আছেন।
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনকারীরা বলছেন- উত্তাল দিনগুলোতে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নির্বিচারে নিরীহ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেছেন তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা এখনো কীভাবে বহাল আছেন- এমন প্রশ্ন তুলে আন্দোলনে যুক্ত একজন ছাত্র বলেন- তাদের পুলিশ বিভাগ থেকে সরিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ বিষয়ে পুলিশের আইজি বাহারুল আলম বলেন- জুলাই বিপ্লবের ঘটনায় অনেক মামলা হয়েছে। মামলাগুলোতে আসামি অনেক। এসব মামলা আমরা পর্যালোচনা করছি। যারা জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। কেউ জড়িত না থাকলে শুধু পুলিশ হওয়ার কারণে যেন হয়রানির শিকার না হন- সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।
তিনি বলেন- যেসব ওসির বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে নেওয়া হয়েছে ব্যবস্থা।