দুই সপ্তাহে ৩ শতাধিক মানুষকে ঠেলে দিয়েছে ভারত, কী করবে বাংলাদেশ?

কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :

কাশ্মীরের পহেলগামকাণ্ডে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত চলাকালীন বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে নীরবে ‘পুশইন’ করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। গত দুই সপ্তাহে প্রায় সাড়ে তিনশ মানুষকে বাংলাদেশের সীমানায় ঠেলে দিয়েছে দেশটি। দিল্লিকে চিঠি দিলেও তাতে উল্লেখযোগ্য সাড়া মেলেনি। পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ পাল্টা পুশব্যাকের চিন্তা করছে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বলছে, সীমান্তে ভারতের পুশইন সুপরিকল্পিত ও ন্যক্কারজনক। যথাযথ প্রক্রিয়ায় পুশইন না করায় বিএসএফের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মৌখিক ও লিখিতভাবে প্রতিবাদলিপি পাঠিয়ে জোরালো প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এছাড়া পুশইন রোধে বিজিবি সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল তৎপরতা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থেকে সজাগ দৃষ্টি রাখছে।

জানা যায়, এখন পর্যন্ত ভারত থেকে পুশইনের মাধ্যমে আসা ২৬২ জনকে বিজিবি আটক করেছে। এদের মধ্যে ২২৩ জন বাংলাদেশি, ১৯ জন রোহিঙ্গা এবং বাকি ২০ জনের পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি। আর সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে কোস্ট গার্ড আটক করেছে ৭৮ জনকে। সাতক্ষীরায় ৭৮ জনের মধ্যে তিনজন জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিক। মোট আটকের সংখ্যা ৩৪০ জন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি গভীর উদ্বেগের বিষয়। এটি চূড়ান্তভাবে সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলছে। এছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে পুশইনের বিষয়ে প্রতিবাদ জানানো যেতে পারে, যা হচ্ছে তা আইনসম্মত নয়। এভাবে চলতে থাকলে ভারত পুশইনের সুযোগ নিয়ে কোনো বড় অপরাধীকেও পাঠাতে পারে।

বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশও ভারতে পুশব্যাক করার চিন্তা করছে। বাংলাদেশে অনেক ভারতীয় নাগরিক আছেন, যাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। তাদের বিষয়ে নজরদারি চলছে।

যেসব সীমান্ত দিয়ে পুশইন :
সবশেষ গত ১৪ মে সিলেট ও মৌলভীবাজার সীমান্ত দিয়ে আরও ৬০ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে বিএসএফ। মৌলভীবাজারের বড়লেখা সীমান্ত দিয়ে ৪৪ জন ও সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ১৬ জনকে পাঠানো হয়েছে বলে বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়। তারা এখন বিজিবির অধীনে। আটকদের মধ্যে ১৩ জন পুরুষ, ১৮ জন নারী ও ১৩ শিশু।

এর আগে গত ৯ মে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ৭৮ জনকে ফেলে যায় বিএসএফ। পরে তাদের আটক করে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। পুলিশ বলছে, এদের মধ্যে ৭৫ জন বাংলাদেশি ও তিনজন ভারতীয় নাগরিক। উদ্ধারদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, তাদের গুজরাট থেকে উড়োজাহাজ-লঞ্চে করে চোখ বেঁধে আনা হয়েছে, অনেকে অসুস্থ এবং কারও কারও শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন আছে।

এর আগে গত ৭ মে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে পুশইন করানোর পর ১২৩ জনকে আটক করে বিজিবি। তাদের মধ্যে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা, শান্তিপুর ও পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী ব্যক্তিরাও জানান, তাদের গুজরাট থেকে উড়োজাহাজে করে প্রথমে ত্রিপুরায় নিয়ে আসেন বিএসএফ সদস্যরা। তারপর এক ঘণ্টা হাঁটিয়ে সীমান্ত দিয়ে এ পারে ঠেলে দেওয়া হয়। এদের ভেতর বাংলা ভাষাভাষী ছাড়াও রোহিঙ্গা ও গুজরাটি ভাষায় কথা বলা মানুষও ছিল বলে জানায় স্থানীয় প্রশাসন।

পুশইন বন্ধে দিল্লিকে চিঠি ঢাকার :
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পুশইনের ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতের কাছে কূটনৈতিক পত্র দিয়েছে বাংলাদেশ। অনতিবিলম্বে পুশইন বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে ৯ মে এই চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়।

ভারতের কাছে চিঠিতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির বাংলাদেশি নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর বিদ্যমান প্রক্রিয়া মেনে বাংলাদেশ তাদের ফেরত নেবে। এর ব্যত্যয় হলে দুই দেশের বোঝাপড়ার মধ্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। একইভাবে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশের পরিবর্তে তাদের আদি নিবাস মিয়ানমারেই ফেরত পাঠানো উচিত ভারতের। কোনোভাবে ভারতীয় নাগরিকদের জোর করে বাংলাদেশে পুশইন করাটা উচিত হবে না। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে এ ধরনের পুশইন অগ্রহণযোগ্য এবং তা পরিহার করা উচিত।

সীমান্ত দিয়ে মানুষ প্রবেশ করানো গ্রহণযোগ্য নয় :
আলোচিত এ ঘটনা প্রসঙ্গে গত ৭ মে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান বলেন, আমরা প্রতিটি কেস আলাদা আলাদাভাবে নিরীক্ষণ করছি। আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আমাদের দেশের নাগরিক যদি কেউ হয়ে থাকেন, আর সেটা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তাদের আমরা গ্রহণ করবো। তবে এটা ফরমাল চ্যানেলে হতে হবে। এভাবে পুশইন করাটা সঠিক প্রক্রিয়া নয়।

পরদিন ৮ মে এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়ে ভারতকে অবিলম্বে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধের আহ্বান জানানো হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক চিঠিতে। ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে এ ধরনের পুশইন গ্রহণযোগ্য নয়।

সীমান্তে ভারতের পুশইন সুপরিকল্পিত এবং ন্যক্কারজনক বলে মন্তব্য করেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। একই সঙ্গে ভারত শরণার্থী রোহিঙ্গাদের পুশইন করছে, এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল বলেও জানান তিনি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি বলেন, গত ৭ ও ৮ মে দুদিনে আমরা ২০২ জনকে পেয়েছি। তাদের বিএসএফ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় পুশইন করেছে। এমন জায়গায় করেছে, যেখানে জনগণ নেই, জনবসতি নেই, সে সব জায়গায়। আপনারা জানেন, সীমান্তের প্রতিটি স্পট ফিজিক্যালি অকুপাই করে রাখা যায় না। যে জায়গায় কেউ ছিল না, সেখানেই পুশইন করেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্মসচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পুশইন ভবিষ্যতে আরও হবে কি না তা বলা যাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ থেকে পুশব্যাক করার চিন্তা সরকারের আছে। ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেলে আলোচনা হচ্ছে।’

সীমান্তে নিরাপত্তার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সীমান্তে নিরাপত্তা ঘাটতি নেই, কিন্তু কিছু সীমানা এলাকা যেমন সুন্দরবন, যেখানে মানুষ যায় না। সেই নির্জন এলাকা যেখানে চারদিক পানি আর কিছু এলাকা দুর্গম চর- সেখানে ছেড়ে দিয়েছে ৭৫ জনকে। আগে বিএসএফ ফাঁকফোকর খুঁজতো না, মূল সীমানা দিয়ে পাঠাতো।’

পুশব্যাকের কথা জানতে চাইলে যুগ্মসচিব ড. জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘কিছু লোককে শনাক্তকরণের কাজ চলছে, যাদের এনআইডি কার্ড, পাসপোর্ট কিংবা অন্য কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। এ বিষয়ে সরকার কাজ করছে।’


(মূল রিপোর্ট : জাগো নিউজ)