সিলেটে ১৩৬ মামলায় আসামি ৩০ হাজার

কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :

৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর থেকে সারাদেশে থানাগুলোতে হয়েছে মামলা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে এসব মামলা করা হয়।  এর তালিকা বাদ যায়নি সিলেটও। এ জেলা ও সিটি করপোরেশন আওতাভুক্ত থানাগুলোতে হয়েছে ১৩৬টি মামলা, যার মধ্যে ১৬টি হত্যার। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার জনকে। অথচ, গত এক বছরে গ্রেফতার হয়েছে মাত্র ৩০০ আসামিকে। মামলার তদন্তেও নেই তেমন অগ্রগতি। তদন্তের মন্থরগতি নিয়ে হতাশ শহীদ পরিবারসহ বাদীপক্ষ। শুধু তারা নন, আইনবিদরাও উদ্বিগ্ন তদন্ত নিয়ে।

আইনবিদ অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির মামলা তদন্তের মেয়াদ যেখানে ১২০ দিন, সেখানে ৩৬৫ দিন অর্থাৎ এক বছরেও মামলার দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। তদন্তে বিরাট অবহেলা-গাফিলতি হচ্ছে। গুলির ঘটনায় অস্ত্র বা কার্তুজ উদ্ধার, শহীদদের লাশের ময়নাতদন্ত, অপারগতায় ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি, ঘটনা-সংশ্লিষ্ট আলামত সংগ্রহ অত্যন্ত জরুরি ছিল। যদিও চরম উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ঘটনার পরপরই অথবা মামলার পর এসব সংগ্রহে বিরাট গাফিলতি হয়েছে। এখন চাইলেও সেসব আলামত আর সংগ্রহ করা যাবে না। ফলে মামলাগুলোর ন্যায়বিচার নিয়ে শঙ্কিত হতেই হচ্ছে। যথাযথ আলামত জব্দ ও হাজির না করলে স্পর্শকাতর মামলার আসামিরাও খালাস পেয়ে যেতে পারে।

এ আইনজীবী বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির মামলার আসামি পলাতক থাকলেও তদন্তে তেমন সমস্যা হয় না। তবে, কোনো মামলার আসামি সংখ্যা বেশি হলে নিরীহ-নিরপরাধ লোকজনের হয়রানির আশঙ্কা থাকে। অনুরূপ বক্তব্য দিয়েছেন আরও কয়েকজন আইনজ্ঞ।

এনসিপি সিলেট জেলার প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন শাহান বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মামলার ন্যায়বিচার গোটা দেশবাসীর কাম্য। মামলাগুলোর অধিকাংশই স্পর্শকাতর। তাই তদন্তে আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। শহীদ পরিবারের পাশাপাশি মামলার বাদীরা ন্যায়বিচারের জন্য অধীর অপেক্ষায়। তদন্তের প্রক্রিয়া ও মন্থরগতি নিয়ে বিভিন্ন মহল অভিযোগ তুলেছে। কোনো কারণে মামলাগুলোর তদন্ত যথাযথ না হলে কিংবা প্রলম্বিত হলে এর দায় অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের ওপরই বর্তাবে। আর আসামি গ্রেফতার নিয়েও অনেক গুঞ্জন রয়েছে। তবে মামলার নামে নিরীহ-নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হলে তা এনসিপি মেনে নেবে না।

সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দেলনে প্রথম শহীদ শাবিপ্রবির ছাত্র রুদ্র সেন। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বড় বোন সুস্মিতা সেন হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এক বছর হয়ে গেছে তবুও তদন্তের আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। মামলার সাক্ষী আলী আব্বাস শাহিন বলেন, আমরা খুবই হতাশ। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এই সরকার তারাও সেদিকে নজর দিচ্ছেন না।

সিলেটে শহীদ সাংবাদিক আবু তুরাবের ভাই আবুল আহছান মোহাম্মদ আজরফ বলেন, মামলার অগ্রগতি নিয়ে আমরা হতাশ। এসএমপি থেকে পিবিআই, সেখান থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন মামলাটি তদন্তাধীন। প্রকাশ্য দিবালোকে একজন পেশাদার সাংবাদিককে গুলি করে হত্যার ঘটনার তদন্ত এখনো অনেক দূর।

সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, মামলাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। এ কারণেই হেডকোয়ার্টারের বিশেষ সেলের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। তদন্তে গাফিলতির কোনো সুযোগই নেই। আলামত সংগ্রহেই অনেক সময় চলে যাচ্ছে। তারপরও তদন্তকারীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, তদন্ত এগোয়নি এটা ঠিক নয়। অনেক মামলার তদন্তই অনেকদূর এগিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে গোলাপগঞ্জে দুজনকে গুলি করে হত্যা মামলার চার্জশিট আগামী আগস্টের মধ্যে হতে পারে।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. রেজাউল করিম বলেন, অনেক মামলা, সব মামলারই তদন্ত চলছে। পুলিশের সর্বোচ্চ মহল থেকে সার্বক্ষণিক তদারকি করা হচ্ছে। তবে লাশের ময়নাতদন্ত না হওয়াসহ কিছু বিষয় তদন্তে কিছুটা স্থবিরতা আনছে। সাংবাদিক তুরাব হত্যা মামলা পিবিআইয়ের হাত ধরে এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। আরও কটি মামলার তদন্ত বেশ এগিয়েছে। তদন্তে মামলার অভিযোগের সত্যতা যাচাই, সত্যের সাথে মিথ্যার মিশেলে নিরীহ-নিরপরাধ কেউ যাতে হয়রানি না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।

জানা গেছে, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান কেন্দ করে সিলেট জেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকার থানাগুলোতে ১৬টি হত্যা এবং ১২০টি বিস্ফোরক ও হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে।  এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের থানাগুলোতে ৯২টি মামলা হয়েছে।

আসামির সংখ্যা শুধু জেলায় সাড়ে ৯ হাজার। এর মধ্যে এজাহারনামীয় দুই হাজার ৩২১ জন এবং অজ্ঞাত সাত হাজার ১৮৫ জন। এর মধ্যে ১০২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন পাঁচটি মামলার বাদী।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) দায়ের করা মামলাগুলোতে আসামি ২০ হাজার ২২২ জন। এর মধ্যে এজাহারনামীয় ছয় হাজার ৪৮২ জন এবং অজ্ঞাত ১৩ হাজার ৭৪০ জন। এতে ১৭৭ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

এদিকে, ১৬টি হত্যা মামলায় শীর্ষ অভিযুক্ত সিলেট-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তাকে গোলাপগঞ্জে সাতটি ও বিয়ানীবাজার থানায় দুটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। জেলা ও মহানগর এলাকায় দায়ের করা সর্বাধিক ৪৩টি বিস্ফোরক মামলার আসামি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম। তিনটি হত্যা মামলাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

হত্যা মামলায় দ্বিতীয় অবস্থানে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ। তার বিরুদ্ধে আটটি হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে ৩৬টি মামলা রয়েছে। হত্যা মামলায় তৃতীয় স্থানে রয়েছেন বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব। তিনি সাতটি হত্যা মামলাসহ অসংখ্য বিস্ফোরক মামলার আসামি।

বিস্ফোরক মামলায় দ্বিতীয় স্থানে আছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তার বিরুদ্ধে দুটি হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে ৪১টি মামলা হয়েছে। এছাড়া হত্যা মামলায় যৌথভাবে চতুর্থ স্থানে আছেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান, গোলাপগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল ইসলাম রাবেল, ফুলবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান হানিফ খান ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আলী আকবর ফখর। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ছয়টি করে হত্যাসহ অসংখ্য মামলা রয়েছে।

(মূল রিপোর্ট : যুগান্তর)