মোহাম্মদ হাননান
ইসলামি জীবনব্যবস্থায় ‘মুয়ামালাত’ ও ‘মুয়াশারাত’ গুরুত্বপূর্ণ বিধান। মুয়ামালাতকে লেনদেন অথবা দেনা-পাওনা কিংবা মানুষের হক আদায়ও বলা যেতে পারে। আর মুয়াশারাত হলো, আচার-আচরণ, অথবা আচার-ব্যবহার। (মোহাম্মদ হারুন রশিদ সম্পাদিত ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ব্যবহৃত বিদেশি শব্দের অভিধান’, বাংলা একাডেমি, ২০২০, পৃষ্ঠা ৪১৪)। দুটিই বাংলা ভাষা থেকে হারিয়ে যাওয়া আরবি শব্দ। তবে বাংলা একাডেমির এ অভিধানে মুয়াশারাতকে লেখা হয়েছে ‘মুয়াশেবাত’। এটি একটি ভুল শব্দ।
যার লেনদেন সুন্দর সে জান্নাতে শহীদদের সঙ্গে থাকবে (তিরমিযী শরিফ)। কিন্তু কেউ যদি ঋণ পরিশোধ না করেই মৃত্যুবরণ করে, সে যদি ঋণ শোধ না করে শহীদও হয়, তবু সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। শহীদদের সব গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দেবেন। কিন্তু ঋণ পরিশোধ না থাকলে তিনি আটকে যাবেন (আবু দাউদ ও মুসলিম শরিফ এবং মুসনাদে আহমাদ)। ‘তোমাদের মধ্যে সবচাইতে উত্তম লোক সে, যে ধার পরিশোধের ব্যাপারে উত্তম (মুসলিম শরিফ)।
ইমাম বোখারি যেসব হাদিস সংকলন করেছেন, তাতে বলা হয়েছে, আখেরাতে এক লোক আল্লাহর কাছে বলতে থাকবে যে, তার বিশেষ কোনো আমল নেই, তবে দুনিয়ায় সে যে ব্যবসা-বাণিজ্য করত, তাতে লেনদেনে ধনীদের জন্য সময় ও সুযোগ বৃদ্ধি করে দিত, আর গরিবদের মাফ করে দিত। আল্লাহ এ ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন (বোখারি)।
আমাদের সামনে ব্যবসা-বাণিজ্যে এমন অবস্থা আছে যে, ব্যবসায়ীরা বিক্রীত মাল ফেরত নিতে রাজি হন না। কেউ কেউ বিক্রির রশিদে লিখে দেন যে, ‘বিক্রীত মাল ফেরত নেয়া হয় না’। ঢাকার বাংলা মোটরে গাড়ির যন্ত্রপাতির বিক্রির দোকানে আমি একটি দোকান দেখেছি, যাদের ‘ভিজিটিং কার্ড’-এ লেখা আছে, ‘বিক্রীত মাল ফেরত নেয়া হয়’। রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানের বিক্রয়কৃত অথবা খরিদকৃত জিনিস ফেরত নিতে রাজি থাকে, আল্লাহ তাআলা তাকে মাফ করে দেন।’ হাদিসটি আবু হোরায়ারা (রা.) থেকে বর্ণিত (আবু দাউদ শরিফ)।
ব্যবসায়ীরা বেশির ভাগ কিয়ামতের দিন গুনাহগার হিসেবেই কবর থেকে উঠবে। তবে যেসব ব্যবসায়ী তাদের বাণিজ্যে পরহেজগারী অবলম্বন করেছে, খেয়ানত করেনি, মানুষকে ঠকায়নি, ধোঁকাবাজিতে লিপ্ত হয়নি, লেনেদেনে মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে, তারা গুনাহগারদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে না (তিরমিযী)।
আর মানুষের মুয়াশারাতের বড় সমস্যা হলো, সে নিজের বড় ত্রুটিগুলো দেখতেই পায় না, অথচ অন্যের ছোট ছোট দোষ তার চোখে লেগে থাকে। ইবনে হিব্বান নামক হাদিস সংকলনে উপমা দিয়ে বলা হয়েছে, মানুষ অন্যের খড়কুটাও চোখে দেখে ফেলে, কিন্তু নিজের কড়িকাঠটাও চোখে (বড় কাঠের ভিম) দেখতেই পায় না (ইবনে হিব্বান)।
মুসা (আ.) একবার আল্লাহ সোবহানুহু তাআলাকে বললেন, হে আমার পালনকর্তা, আপনার কাছে সবচেয়ে সম্মানিত কে? আল্লাহ বলেন, ‘ওই বান্দা, যে প্রতিশোধ নিতে পারে, কিন্তু প্রতিশোধ না নিয়ে মাফ করে দেয় (হাদিস শরিফ বায়হাকি)। সাহাবা আযমাইনও (রা.) একবার নবী (সা.) কে প্রশ্ন করেছিলেন, কোন মুসলমানের ইসলাম শ্রেষ্ঠ? নবী উত্তর দিলেন, যে মুসলমানের মুখ ও হাত থেকে মানুষ নিরাপদ থাকে (বোখারি)। ফাতহুল বারি কিতাবে এ হাদিসের ব্যাখ্যায় এসেছে যে, ‘মুখ থেকে নিরাপদ থাকা মানে’, কাউকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা, কাউকে অপবাদ দেয়া, গালিগালাজ ইত্যাদি গর্হিত কাজ করা। আর ‘হাত থেকে নিরাপদ’ মানে মারধর করা, অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে নিয়ে নেয়া বা ভোগ করা।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে বলা হয়েছে, নবী (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ ওই সময় পর্যন্ত পূর্ণ ইমানওয়ালা হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার মুসলমান ভাইয়ের জন্য ওটিই পছন্দ না করবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করবে (বোখারি)। মুসনাদে আহমাদে এ হাদিসের বিশদ বিবরণ রয়েছে। রাসুল (সা.) সাহাবা (রা.)-দের বললেন, তোমার ভাইয়ের জন্য সেটিই পছন্দ কর যা নিজের জন্য পছন্দ করেছ।
লোকমান (আ.) তার ছেলেদের যেসব নসিহত করেছিলেন, তার মধ্যে একটি হলো, মানুষের সঙ্গে অবজ্ঞাসূচক ব্যবহার করিও না। আর আল্লাহর এ জমিনের ওপর দম্ভভরে চলিও না। আল্লাহ দাম্ভিক ও অহংকারী মানুষকে পছন্দ করেন না। নিজ চলনে-বলনে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর। আর নিম্নস্বরে কথা বল, শোরগোল করিও না (সূরা লোকমান, আয়াত ১৮-১৯)।
আমাদের আচার-আচরণগুলো সব এমনই হওয়া উচিত। নবী (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ওই ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে (মুসনাদে আহমাদ)। অন্যত্র আছে, ‘ওই ব্যক্তির চরিত্রই সবচেয়ে ভালো, যে নিজের পরিবারের সঙ্গে নরম ব্যবহার করে’ (তিরমিযী)। এ আচরণ যেমন গৃহে হবে, তেমনি বাইরেও হবে। নবী (সা.) আশ্চর্য হয়ে বলেছেন, মানুষ কেন উত্তম ব্যবহার দ্বারা মানুষ খরিদ করছে না! যখন একজন অন্যজনের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করে, তখন সে-জন তার গোলাম (বর্তমান জমানায় ‘ভক্ত’) হয়ে যায় হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে, জামে সগীর।
বিনয়ের সঙ্গে চলাকে ইসলামে খুব গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি আল্লাহকে খুশি করতে বিনয় অবলম্বন করে, আল্লাহ তাকে উন্নত করে দেন। যদিও সে নিজের ধারণায় ছোট থাকে, তথাপি আল্লাহ মানুষের কাছে তাকে বড় করে দেন। আর যে নিজেকে অনাবশ্যক বড় করার চেষ্টা করে, আল্লাহ তাকে মানুষের কাছে অবনত করে দেন (হাদিস শরিফ বায়হাকি)। যার অহংকার আছে, সে কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না (মুসলিম শরিফ)।
অধস্তনকে সব সময় মাফ করে দিতে হয়। এ কথা শুনে এক সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসুল (সা.), আমি আমার কর্মচারীকে কতবার ক্ষমা করব। নবী (সা.) উত্তর করলেন, ‘দৈনিক সত্তরবার’ (তিরমিযী)।
বোখারি শরিফে নবী (সা.)-এর নির্দেশনা জানানো হয়েছে, ‘রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কর’। খুব রাগ হয়ে গেলে চুপ করে থাকতে হবে অথবা পানি দ্বারা অজু করে নিতে হবে (মুসনাদে আহমাদ ও আবু দাউদ শরিফ)।
আমরা অনেক সময় এমন একটি সভা বা মজলিশে অনুমতি ব্যতীত ঢুকে পড়ি, যখন কেউ একান্তে আলাপ করার জন্য বসেছিল। কিন্তু এমনটি ঠিক নয়। নবী (সা.) বলেছেন, দুই ব্যক্তির মাঝখানে তাদের অনুমতি ব্যতীত বসবে না (আবু দাউদ)।
কেউ যদি বিপদে পড়ে, তখন তার পাশে দাঁড়াতে হবে এবং তাকে ধৈর্য ধরা ও শান্ত থাকতে বলতে হবে। যে এমনটি করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন মর্যাদাসম্পন্ন পোশাক পরিয়ে দেবেন (ইবনে মাজাহ)।
মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পরস্পর সমানতালে চলার চেষ্টা করা হয়। কেউ ভালো ব্যবহার করলে আমরা প্রত্যুত্তরে ভালো ব্যবহার করে থাকি, কেউ খারাপ ব্যবহার করলে পাল্টা খারাপ ব্যবহারে তৎপর হয়ে যাই। কিন্তু নবী মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, কেউ ভালো ব্যবহার করলে যেমন ভালো ব্যবহার করব, তেমনি কেউ জুলুম করলেও তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। জুলুমের প্রত্যুত্তরে জুলুম নয় (তিরমিযী)।
সমাজে বড়দের শ্রদ্ধা করা, ছোটদের আদর করা এবং আলেমদের সম্মান করা ছোটবেলা থেকেই শিখতে এবং শেখাতে হবে। নবী (সা.) বলেছেন, এটি যারা না করে তারা তার উম্মত নয় (মুসনাদে আহমাদ ও তাবারানী)।
নবী মানুষকে মুয়াশারাত শেখাতে গিয়ে বলেছেন, মানুষের সঙ্গে দেখা করে একটি মুচকি হাসি দাও। ভালো কাজের পরামর্শ দাও, খারাপ কাজে বাধা প্রদান কর। পথহারাকে পথ দেখিয়ে দাও। রাস্তার পাথর, কাঁটা, হাড্ডি ইত্যাদি কষ্টদায়ক জিনিস থাকলে সরিয়ে দাও। নিজের বালতি থেকে কোনো ভাইয়ের বালতিতে পানি ঢেলে দাও (তিরমিযী)। যে কেউ কারও প্রয়োজন মিটিয়ে দেয়, আল্লাহ সোবহানুহু তাআলা তার প্রয়োজন মিটিয়ে দেবেন (আবু দাউদ)। আর মানুষের দোষ-ত্রুটি বলে বেড়াবে না, গোপন রাখবে। যে মানুষের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবে, আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন (মুসনাদে আহমাদ)।
নবী (সা.) তিনটি জিনিস কেউ চাইলে অবশ্যই দেয়ার নির্দেশ করেছেন। কাউকে এ ক্ষেত্রে ফিরিয়ে দেয়া যাবে না। এক হলো- বালিশ। দুই. খুশবু অথবা আতর-সুগন্ধি। তিন. দুধ (তিরমিযী)। কেউ হাদিয়া হিসেবে ফুল দিলে তাও ফিরিয়ে দেয়া যাবে না (মুসলিম)।
তিন দিনের বেশি কারও সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে রাখা যাবে না (আবু দাউদ)। আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না। এতিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে এবং মিসকিনকে খানা খাওয়াতে হবে (মুসনাদে আহমাদ)।
নারীদের প্রতি ভালো ব্যবহারের খুব তাগিদ দিয়েছেন মোহাম্মদ (সা.)। বলেছেন, কন্যাসন্তান ও বোনদের দায়িত্ব গ্রহণ কর, জান্নাতে যাবে (বোখারি)।
যে ব্যক্তি নিজে পেট ভরে খায় অথচ তার পাশে বসবাসকারী ক্ষুধার্ত থাকে, সে কখনো মোমিন নয়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে এ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আর এটি সংকলিত হয়েছে আবু ইয়ালায়। এভাবে প্রতিবেশীর মর্যাদা ও জিম্মাদারীকে নবী (সা.) খুব বড় করে দেখেছেন। অন্যত্র এক জায়গায় বলেছেন, যদি প্রতিবেশী কিছু চায়, তবে তাকে তা দাও। প্রতিবেশী দাওয়াত দিলে যেতে হবে। সে অসুস্থ হয়ে গেলে দেখতে যেতে হবে। যদি সে মারা গিয়ে থাকে, তাহলে তার জানাজায় যেতে হবে। প্রতিবেশী বিপদে পড়লে তাকে সান্ত্বনা দিতে হবে। অভাবী প্রতিবেশীর কাছে থেকে গোশত রান্না করলে, পারলে কিছু তার কাছে পাঠাও, না পারলে সামান্য সুরা হলেও পাঠাও। তুমি এমন করে দালান-ইমারত বানাবে না, যাতে প্রতিবেশীর ঘরে বাতাস যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় (তারগিব)।
বস্তুত মুয়ামালাত ও মুয়াশারাত ইসলামি আদর্শে এমন একটি বিষয় যা একজন মুসলিমকে সতত নেকপথে চলতে সাহায্য করে। আল্লাহর এবাদত কম করলে আল্লাহ হয়তো তা মাফ করে দেবেন। কিন্তু মুয়ামালাত-মুয়াশারাত বান্দার হক, মানুষের হক, আল্লাহ তাআলা এখানে তার কর্তৃত্ব রাখেননি। প্রতিটি মানুষকে তার লেনদেন আর আচার-ব্যবহারের জন্য বান্দার কাছেই কৈফিয়ত দিতে হবে। সে যদি জিহাদে গিয়ে একজন শহীদও হন, তবু এর সমাধান না করে জান্নাতে যেতে পারবেন না। অন্যদের অবস্থা তাহলে কী হবে!
লেখক: ইতিহাসবিদ ও গবেষক