কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :
স্থানীয়দের মাঝে আশা জাগিয়ে চোখের সামনে গড়ে উঠেছিল সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বাল্লা স্থলবন্দরের অবকাঠামো। শেষ পর্যন্ত সেটি আর কার্যকর হলো না।
বুধবার (২৭ আগস্ট) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের ৪০তম বৈঠকে এ বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত অনুমোদন হয়। এর ফলে স্থলবন্দরের ভবিষ্যৎ নিয়ে এবং সেখানকার মূল্যবান জিনিসিপত্র লুট ও বেদখলের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মূলত সীমান্তের ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়মুড়া এলাকায় কোনো স্থলবন্দর গড়ে না ওঠায় শুরু থেকেই বাল্লার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এর পরও ওয়্যারহাউস, ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড, ট্রাক পার্কিং ইয়ার্ড, প্রশাসনিক ভবন ও ডরমিটরিসহ একটি ব্যয়বহুল সর্বাধুনিক স্থলবন্দরের অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়, যাতে ব্যয় হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
সরেজমিন বন্দর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সরকারি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় স্থলবন্দরে মানুষের আনাগোনা নেই। অনেকে ঘুরতে এসে সুন্দর ভবনের সামনে ছবি তোলেন। বন্দর এলাকায় অব্যবহৃত পড়ে থাকা ভবনগুলোতে এরই মধ্যে ক্ষত দেখা দিতে শুরু করেছে। মরিচা ধরেছে দরজা-জানালার কপাট ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশে। বিলাসবহুল ভবনের গায়ে ও প্রাঙ্গণে ময়লা জমেছে জায়গায় জায়গায়। ভেতরে স্থানীয়দের ছাগল চরে বেড়াচ্ছে।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত বহুল আলোচিত এই বাল্লা স্থলবন্দর নির্মাণে সরকারের প্রায় ৪৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। আধুনিক এই স্থাপনা এখন অচল পড়ে আছে। বিশাল অবকাঠামো ব্যবহার না হওয়ায় পরিণত হয়েছে গোচারণভূমিতে আর ভবিষ্যতে পুরোপুরি বেদখল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। তাদের অভিযোগ, কার্যকর পরিকল্পনা ছাড়া স্থলবন্দর নির্মাণ করে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ বাল্লা স্থলবন্দরের নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রায় ১৩ একর জমি অধিগ্রহণের পর ২০২৩ সালের জুনে শেষ হয় নির্মাণকাজ। এক আওয়ামী লীগ নেতা এরই মধ্যে বন্দর এলাকার কিছু অংশ দখল করে হালচাষও শুরু করেছেন। এমনটাই জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী বলেন, সরকার কার্যক্রম বন্ধ করায় বন্দর অরক্ষিত হয়ে পড়বে। এখনই রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে, নইলে বেদখল হয়ে যাবে। চুনারুঘাট ইউএনও মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জানান, তিনি নতুন যোগদান করেছেন। খোঁজ নিয়ে বাল্লা স্থলবন্দর যাতে বেদখল না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অপরদিকে চুনারুঘাট উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মীর সিরাজ বলেন, লোক দেখানো উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকা নষ্ট করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। কার্যকর পরিকল্পনা ছাড়া এত টাকা খরচ করে বন্দর বানানো হয়েছে, যা এখন অচল।
ব্যবসায়ী সিরাজ মিয়া বলেন, তারা ভেবেছিলেন বন্দর চালু হলে ভারতীয় বাজারের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্য করতে পারবেন। এ ছাড়া কর্মসংস্থান হবে, অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। এখন বন্দরের কার্যক্রম স্থগিত হওয়ায় সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে। আরেক ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ভারতের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়াই এত টাকা খরচ করে স্থাপনা বানানো হয়েছে। এখন সেটি গোচারণভূমিতে পরিণত হয়েছে।
শামীম আলম বলেন, কোটি টাকার অবকাঠামো এখন ছাগলের চারণভূমি। সরকার অবকাঠামো রক্ষায় ব্যবস্থা নিক এবং ভবিষ্যতে এর ব্যবহার নিশ্চিত করুক। স্থলবন্দর নির্মাণের আগে শতাধিক পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, তাদের অনেকেই ক্ষতিপূরণের পুরো টাকা পাননি। এখনও ১৩টি পরিবার বন্দর সীমানার ভেতরে বসবাস করছেন। বন্দরের ইদ্রিস আলী জানান, শেষ সম্বল ৫ শতক জমি বাল্লা বন্দরের ভেতরে পড়েছিল। সরকার ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিলেও টাকা পাননি তিনি। বন্দরও হলো না, জমিও গেল।
বাল্লা শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর ঘোষণার পেছনে ভূমিকা ছিল হবিগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি মাহবুব আলীর। তিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। পাশাপাশি শায়েস্তাগঞ্জের অশোক মাধব রায় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব থাকাকালে এর প্রাথমিক কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। ২০১৬ সালে তাঁর অবসর গ্রহণের পর মূল কাজ বাস্তবায়িত হয়। সাধারণ মানুষ বলছেন, স্থলবন্দর চালু হলে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হতো। এর কার্যক্রম বন্ধ করায় উন্নয়নের সুযোগ হাতছাড়া হলো।
এখন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে- কোটি টাকার এ প্রকল্প বেদখল হয়ে যেতে পারে।
(মূল রিপোর্ট : সমকাল)