মাহফুজ হোসাইনী >>
‘কওমি শিক্ষা’ জাতির রাহবার। সঠিক সম্ভাবনা ও প্রদীপ্ত আশার আলো। পৃথিবীতে যুগে যুগে যে সকল শিক্ষার আবির্ভাব হয়েছে তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ হলো কওমি শিক্ষা। যার সূচনা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে। আল্লাহ পাক নিজেই এই শিক্ষার সর্বপ্রথম শিক্ষক। ইরশাদ হয়েছে- ‘করুণাময় আল্লাহ্। তিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সুরা-রাহমান, আয়াত-১,২)
আল্লাহ্ তায়ালা হযরত জিবরাইলের মাধ্যমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই শিক্ষা দিয়েছেন। অতঃপর এই শিক্ষার অমীয় সূধা পান করে তৃপ্ত হয়েছেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি., আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি, আবু হুরায়রা রাযি.। সৃষ্টি হয়েছেন ইমাম আবু হানিফা রহ., ইমাম শাফেয়ী রহ., ইমাম মালিক রহ., ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. প্রমুখ আইম্মায়ে কেরাম।
সত্যিকারার্থে কওমি শিক্ষাই হলো আলোর দিশারী। যেই আলোয় আলোকিত হয়েছেন শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ., হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী রহ., সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ রহ., কাসিম নানুতুবী রহ., এর মত বিখ্যাত ব্যক্তিরা। যারা জাতির ক্রান্তিলগ্নে ইংরেজ বেনিয়াদের জুলুম থেকে ধর্ম দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে গড়ে তুলেন কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’ মাদরাসা। সেই প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরি হয়েছেন শায়খ মাহমুদ দেওবন্দী রহ., হুসাইন আহমদ মাদানী রহ., ওবায়দুল্লাহ সিন্দী রহ. সহ দেওবন্দী ওলামায়ে কেরাম। যাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ও বিপ্লবী হুংকারে কেঁপে উঠেছে ব্রিটিশ বেনিয়াদের মসনদ। তাদের প্রচেষ্টাতেই স্বাধীনতার মুখ দেখেছে শত বছরের মজলুম জনতা। জাতি, ধর্ম ও দেশপ্রেমের আস্থার প্রতীক ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’। আর সেই দারুল উলূম দেওবন্দকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কওমি মাদরাসা।
কওমি শিক্ষা কী :
কওমি শিক্ষা মানে নববী শিক্ষা। এটি সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এ শিক্ষার মৌলিক সিলেবাস প্রণয়নকারী বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামি। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের মধ্য থেকে এমন একজন নবী পাঠিয়েছেন। যিনি তাদের সম্মুখে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন, তাদেরকে আত্মশুদ্ধি করেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) শিক্ষা দেন। বস্তুতঃ তারা ছিল পূর্ব থেকেই পথভ্রষ্ট।’ (সুরা-আল ইমরান, আয়াত-১৬৪)
আয়াতে নববি শিক্ষার মৌলিক সিলেবাস উল্লেখ করা হয়েছে চারটি।
১। কুরআনুল কারীমের আয়াতসমূহের তিলাওয়াত ও তার শিক্ষা প্রদান।
২। তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধি করা। অর্থাৎ শিরক, পাপাচার ও আধ্যাত্মিক ব্যাধি থেকে পবিত্র করা এবং এর দীক্ষা প্রদান।
৩। কুরআনুল কারীমের তাফসীর ও বিধিবিধানের শিক্ষা প্রদান।
৪। হিকমাহ তথা সুন্নাহ এর শিক্ষা প্রদান।
উপরোক্ত ৪ সিলেবাসের সমন্বয়ই হল নববি শিক্ষা। এর কোনো একটাও বাদ পড়লে নববী শিক্ষা হবে না। তখন সেই শিক্ষাকে নববী শিক্ষা বলা ভুল ও অন্যায় হবে। এই নববি শিক্ষা তথা আল্লাহ্ প্রদত্ত চার সিলেবাসকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠিত কওমি মাদরাসা। তাই বাংলাদেশে একমাত্র কওমি মাদরাসাতেই এই চার সিলেবাসের সমন্বয় পাওয়া যায়।
কওমি মাদরাসার সর্বপ্রথম শিক্ষা হল কুরআনের তিলাওয়াত। তিলাওয়াত ঠিক না হলে ওপরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঠিক তেমনিভাবে তাযকিয়ার ব্যাপারেও রয়েছে শতভাগ সতর্কতা। কওমি শিক্ষার্থীদের সর্বদাই সকল ক্ষেত্রে আত্মশুদ্ধির নজরদারি করা হয়। শিরক, কুফর, বেদাতসহ অন্যান্য সকল প্রকার পাপাচার, অন্যায় ও অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে পবিত্র বা আত্মশুদ্ধি করা হয়। যদি কোনো শিক্ষার্থী আত্মশুদ্ধি করতে সক্ষম না হয় তবে সে কওমি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। পড়ালেখাতে সে যতই ভালো হোক না কেন। কেননা এটা নববী শিক্ষার মূল সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত।
কুরআন তিলাওয়াত ও তাযকিয়ার মতো কুরআনের তাফসীর-বিধিবিধান ও হাদীসেরও পর্যাপ্ত শিক্ষা রয়েছে কওমি সিলেবাসে। আমরা এক কথায় বলতে পারি, কওমি শিক্ষা মানেই নববী শিক্ষা বা দ্বীনি শিক্ষা। আরেকটা কথা না বললেই নয়। আমরা অনেকে মনে করি, মাদরাসা মানেই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটা বাস্তবসম্মত নয়। বাস্তবতা হল, শুধু কওমি মাদরাসাই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কওমি ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো শিক্ষায় পূর্ণাঙ্গ দ্বীনি শিক্ষাব্যবস্থা নেই। দ্বীনি শিক্ষার মূল ভিত্তি ও মৌলিক চার সিলেবাসের প্রথমটি হল ‘কুরআন তিলাওয়াত’। এটা কওমি ছাড়া অন্য কোথাও নেই। অন্য কোনো শিক্ষাধারার সিলেবাসে কেউ দেখাতে পারবে না। সুতরাং মাদরাসা নামকরণ দেখেই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মনে করা যাবে না।
কওমি শিক্ষা কেন :
এক কথায় কওমি শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো নিজে আদর্শবান হয়ে দেশ ও জাতিকে সতর্ক করা। সকল প্রকার অন্যায় থেকে বাঁচিয়ে সুন্দর আদর্শ সমাজ উপহার দেওয়া।
মানবতা, সভ্যতা, নৈতিকতা, মন্দ থেকে বাঁচানোসহ দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তির পথ রয়েছে এ শিক্ষায়। কওমি শিক্ষা অর্জনকারীরা নববী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ভদ্র, সভ্য, নম্র, বিনয়ী এবং মানবিক উন্নত চরিত্রাবলীর অধিকারী হয়। ফলে কওমি শিক্ষার্থীরা ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে পাশ্চাত্বের অন্ধ অনুকরণ করে না। কওমি শিক্ষার্থীরা অল্পে তুষ্ট। পরকল্যাণে সচেষ্ট। দশ ও দেশের জন্য উৎসর্গিত। উম্মত ও জাতির প্রতি দরদ, মায়া ও সম্প্রীতি-ভালবাসা প্রদর্শনের এক অনুপম দৃষ্টান্ত। কওমি শিক্ষার্থীরা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখায়। ধ্বংস থেকে বাঁচিয়ে সুন্দর আদর্শবান সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। অন্যায়-অবিচার ও সমাজের ফেতনা-ফাসাদসহ সকল প্রকার ক্ষতিকর বিষয়াদি থেকে জাতিকে সতর্ক করা এই শিক্ষা অর্জনকারীদেরই দায়িত্ব। এ মর্মেই আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, ‘আর সমস্ত মুমিনের অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। সুতরাং তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হয় না দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য এবং যখন তারা প্রত্যাবর্তন করবে, তখন স্বজাতিকে সতর্ক করবে, যাতে তারা (স্বজাতিরা) বাঁচতে পারে।’ (সূরা-তাওবা, আয়াত-১২২)
কওমি শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও আল্লাহর পক্ষ থেকেই নির্ধারিত। পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো শিক্ষা নেই যার তুলনা কওমি শিক্ষার সাথে করা যেতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য সকল শিক্ষার প্রবর্তক, সিলেবাস প্রণয়ন মানুষের পক্ষ থেকেই হয়েছে। কওমিই একমাত্র শিক্ষাব্যবস্থা, যার প্রবর্তক আল্লাহ। সিলেবাস প্রণয়নকারী আল্লাহ। প্রথম শিক্ষক আল্লাহ। আর উদ্দেশ্যও আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কওমি শিক্ষার সিলেবাসে যে বিষয়গুলো রয়েছে সেগুলো অর্জনে সত্যিকার অর্থে মানুষ হওয়ার গ্যারান্টি রয়েছে। আপনারা সমাজে দেখে থাকবেন, সন্ত্রাস, হানাহানি, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, সুদ-ঘুষ এসব থেকে নিরাপদ দূরত্বে রয়েছেন কওমি শিক্ষা অর্জনকারীরা।
অনেকের ধারণা- কওমি শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে বেকারত্ব বাড়ছে। তাদের পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই। ফলে এই শিক্ষা সমাজের বোঝা। সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ। কিন্তু এ ধারণার কি কোনো বাস্তবতা আছে? যুক্তি নয়, বাস্তবতায় আসুন। চোখ খুলে চারপাশে দেখুন, কওমি ডিগ্রিধারী কয়জন বেকার ঘুরছে? আমার বিশ্বাস, সচরাচর কাউকে খুঁজে পাবেন না। যদিও বাহ্যিকভাবে মনে হয় কওমিদের পর্যাপ্ত কর্মক্ষেত্র নেই। তারা কী করবে? কিন্তু বাস্তবে এর উল্টো। কেননা, তাদের দায়িত্ব বিশ্বের প্রতিপালক মহান আল্লাহ পাকের জিম্মায়।
অথচ জেনারেল শিক্ষার অনেক বড় ডিগ্রিধারীদেরকেও দেখবেন, বেকারত্বের অভিশাপ মাথায় নিয়ে ঘুরছে। সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অপরদিকে কওমি শিক্ষায় ডিগ্রিধারীরা সমাজে সম্মানজনক অবস্থায় কোনো না কোনো কর্মে লেগে আছে। বেকারত্ব দূরীকরণে সমাজে কওমি শিক্ষা শতভাগ ভূমিকা পালন করছে।
পরিশেষে, যে যাই বলুক, কওমির কোনো কর্মক্ষেত্র থাকুক বা নাই থাকুন; আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি কোনো কওমি শিক্ষার্থী যদি কওমি আদর্শ নিয়ে ডিগ্রি অর্জন করে সে কখনও সমাজের বোঝা হবে না। বেকারত্বের অভিশাপ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এটাই চির বাস্তব।
লেখক: বিভাগীয় সম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর