প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ : ট্রেনটিকে গন্তব্যে পৌঁছাইতে হইবে

অন্তর্বর্তী সরকারের শতদিবস উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রবিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে যেই ভাষণ দিয়াছেন, তাহাতে প্রত্যাশিতভাবে জনপরিসরে ঘূর্ণায়মান প্রশ্নগুলির প্রসঙ্গ উঠিয়া আসিয়াছে। ভাষণটিতে একদিকে ছিল জাতির নিকট তাঁহার সরকারের জবাবদিহির প্রচেষ্টা, অন্যদিকে এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে জনগণকে আশ্বস্ত করিবার প্রয়াস। ভাষণটির যেই অংশকে আমরা জবাবিদিহিসুলভ মনে করি, তাহাতে গুরুত্ব পাইয়াছে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে নিহত পরিবারের পুনর্বাসন ও আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার বিষয়টি। প্রধান উপদেষ্টা প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে ৩০ লক্ষ টাকা প্রদান, তৎসহিত আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করিবার কথা বলিয়াছেন। একই অংশে তিনি আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিভিন্ন উদ্যোগ, রিজার্ভে হাত না দিয়া বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ, প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধিসহ জাতীয় অর্থনীতির হাল সম্পর্কে অবহিত করিয়াছেন। এই সময়ের বিশেষ আলোচিত বিষয় ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কেও তিনি বক্তব্য রাখিয়াছেন। তবে অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা চিকিৎসার দাবিতে সম্প্রতি রাজপথে যেই বিক্ষোভ করিয়াছেন, উহার পুনরাবৃত্তি কাঙ্ক্ষিত নহে। তাই ভাষণে প্রদত্ত প্রধান উপদেষ্টার আশ্বাসবাণী দ্রুত বাস্তবায়িত হইতে হইবে। একইভাবে নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখিতে না পারিলে কেবল ভালো কথায় চিড়া ভিজিবে না; মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিগত সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করিয়াও জনগণের মন পাওয়া যাইবে না। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারকে আরও মনোযোগী হইতে হইবে।

প্রধান উপদেষ্টা তাঁহার ভাষণে যেইভাবে বিশেষত রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনী রূপরেখা বিষয়ে আশ্বস্ত করিয়াছেন, তাহাও আশাব্যঞ্জক।
আমরা জানি, ছাত্র-জনতার আহ্বানে সাড়া দিয়া সরকার ইতোমধ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারবিষয়ক সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ১০টি কমিশন গঠন করিয়াছে। প্রধান উপদেষ্টা সেই কমিশনগুলির কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন পেশ করিয়াছেন। তিনি ইহাও পরিষ্কার করিয়াছেন, ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যেই কমিশনগুলি সুপারিশ পেশ করিলে তাহারা তাহাদের অন্যতম অংশীজন রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে বৈঠক করিবেন। সেই বৈঠকের ফলাফলের উপর ভিত্তি করিয়া সরকার পরবর্তী কর্মসূচি গ্রহণ করিবে। তিনি ইহাও বলিয়াছেন, নির্বাচনী সংস্কারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হইলে খুব দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপও পাওয়া যাইবে। কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারকাজ সম্পন্ন করিয়া তাঁহার নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা প্রণিধানযোগ্য বলিয়া আমরা মনে করি। সম্ভবত তাহারই পূর্বধাপরূপে তিনি বলিয়াছেন, কয়েক দিবসের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হইবে। তাহারা বহুল আকাঙ্ক্ষিত একটি সুষ্ঠু, অবাধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলি সরকারের সহায়তায় বাস্তবায়ন করিতে পারিবে।


স্বীকার্য, দীর্ঘদিন যাবৎ রাষ্ট্র সংস্কারের যেই আকাঙ্ক্ষা জনসাধারণের মধ্যে রহিয়াছে, উহা যথাসম্ভব পূরণ হওয়া উচিত। কিন্তু দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং উহার মিত্র, তৎসহিত বাম গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত দলসমূহও যে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিয়া চলিয়াছে, উহাও উপেক্ষণীয় নহে। গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তই হইল নির্বাচিত সরকার কর্তৃক রাষ্ট্র পরিচালনা, যেই সরকার রাজনৈতিক দল দ্বারাই গঠিত হয়। তদুপরি সংস্কারের ভাগ্য চূড়ান্ত অর্থে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের উপর নির্ভর করে। যেই কারণে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলিকে আস্থায় লইয়াই অন্তর্বর্তী সরকারকে যেই কোনো রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হইবে। বর্তমান সরকার এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন বলিয়া প্রধান উপদেষ্টার আলোচ্য ভাষণ হইতে বোঝা যায়। নির্বাচনী রোডম্যাপের অনুপস্থিতির প্রসঙ্গ তুলিয়া রাজনৈতিক দলগুলি কিছুটা হতাশা প্রকাশ করিলেও এই প্রত্যাশা এখন করাই যায়, নির্বাচনী ট্রেন প্রকৃতপক্ষেই যাত্রা করিতে যাইতেছে। এখন আমরা দেখিতে চাহিব, কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের পূর্বে উহা থামিবে না।