কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :
তথ্য-প্রযুক্তি খাতে হাসিনাপুত্রের একের পর এক দুর্নীতির খবর যখন বেরিয়ে আসছে, ঠিক তখনই সেই আমলের ‘বৈঠক’ নামের একটি কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্ম থাকার পরও নতুন একই ধরনের আরেকটি প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দের নামে লুটপাটের ক্ষেত্র তৈরির অভিযোগ উঠেছে।
খাত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ওপেন সোর্স ব্যবহার করে জুমের বিকল্প হিসেবে ‘বৈঠক’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিলেন দেশীয় প্রকৌশলীরা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে পুরস্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি (ডব্লিউএসআইএস) পুরস্কার, ২০২৪-এ উইনার পুরস্কার জিতেছিল এটি।
পরে আধুনিকায়নের নামে একই ধরনের প্ল্যাটফর্ম নতুন করে তৈরির একটি লুটপাটের প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন পলাতক শেখ হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক।
বিসিসির নিজস্ব প্রকৌশলীদের তৈরি ‘বৈঠক’ নামের সেই প্ল্যাটফর্মটির সক্ষমতার মাত্র ৫ শতাংশও এখন ব্যবহার হচ্ছে না। অথচ সেই একই প্ল্যাটফর্ম নতুন নাম ও নতুন মোড়কে ৪৩.৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ফের তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
আওয়ামী সরকার পতনের পরও বিসিসির কিছু কর্মকর্তার আগ্রহে সেই নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজ এখনও চলছে। প্রকল্পের এক কর্মকর্তা আমার দেশকে জানিয়েছেন, এরই মধ্যে বরাদ্দ করা অর্থের ৪০ শতাংশ পরিশোধও করা হয়েছে।
বৈঠক প্ল্যাটফর্মের শুরু :
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) তৈরি ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্ম ‘বৈঠক’ সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয় ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর। করোনা মহামারির সময়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিজিডি-ই-গভ সার্টের নিজস্ব জনবল দিয়ে ‘বৈঠক’ নামের এই ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছিল। এ প্ল্যাটফর্মের প্রাথমিক উদ্বোধন হয় ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল।
সার্টের একদল দক্ষ প্রকৌশলী ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ব্যবহার করে এই প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করেন। প্রাথমিক অবস্থায় ২০২১ সালে এটি তৈরি করতে কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি বিসিসির।
১০ কোটি টাকার কর্মসূচিতে রূপান্তর :
২০২১ সালে ‘বৈঠক’ প্ল্যাটফর্মটি চালুর পর পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্ল্যাটফর্মটি চালু করা হয়। এটিকে আরও নিরাপদ ও অত্যাধুনিক করার উদ্দেশ্যে বিসিসি ৯ কোটি টাকার একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ কর্মসূচির অধীনে ১০ জন প্রকৌশলী নিয়োগ করা হয়। তাদের কাজ ছিল ‘বৈঠক’ প্ল্যাটফর্ম নিয়েই কাজ করা, এর সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করা এবং সমাধান করে আরও ব্যবহার উপযোগী করে তোলা।
বৈঠক প্ল্যাটফর্মের বর্তমান সক্ষমতা :
‘বৈঠক’ প্ল্যাটফর্মটিতে বর্তমানে একই সময়ে প্রায় ৪০টি মিটিং অনুষ্ঠিত হতে পারে, যেখানে প্রতিটি মিটিংয়ে ৫০ জনের মতো অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তাছাড়া ওয়েবিনার মুডে এক মিটিংয়ে সর্বোচ্চ ৪০০ জন অংশগ্রহণ করার মতো সক্ষমতা রয়েছে এতে। রয়েছে উন্নত মানের ভিডিও কোয়ালিটি, ভিডিও রেকর্ডিং, স্ক্রিন শেয়ারিং, গ্রুপ চ্যাটসহ প্রয়োজনীয় সব ফিচার। প্ল্যাটফর্মটির মোবাইল প্ল্যাটফর্মও তৈরি করা হয়েছে, যা অ্যানড্রয়েড ও আইফোন ব্যবহারকারীদের জন্যই উন্মুক্ত।
সক্ষমতার কত ভাগ ব্যবহৃত হচ্ছে :
এই প্ল্যাটফর্মটি ইতোমধ্যে দেশের প্রায় ২০০টি সরকারি প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দেশের সব মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বিভাগীয় কমিশনারদের কার্যালয়সহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান। তবে প্ল্যাটফর্মটি চালু হওয়ার পর থেকে এর ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত।
প্রাপ্ত পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত তিন বছরে এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত মিটিংয়ের সংখ্যা প্রায় ২৫০০টি, অর্থাৎ গড়ে দৈনিক মাত্র ২-৩টি মিটিং। ১০ কোটি টাকা খরচে তৈরি এই প্ল্যাটফর্মের সক্ষমতার মাত্র ৫ শতাংশও এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়নি। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পরিস্থিতি আরও হতাশাজনক। এমন দিনও দেখা গেছে, যখন কেউই এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কোনো মিটিং করেনি। যেখানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন হাজারো অনলাইন মিটিং আয়োজন করছে, সেখানে এই প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার প্রায় শূন্যের কোঠায়।
প্ল্যাটফর্ম পরিচালনায় বিসিসির হার্ডওয়্যার রিসোর্সের ব্যবহার :
সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে একসঙ্গে প্রায় ৪০টি মিটিং পরিচালনা করতে সক্ষম এই প্ল্যাটফর্মটি চালানোর জন্য বিসিসির নিজস্ব ডেটা সেন্টারের রিসোর্স ব্যবহৃত হচ্ছে। বিসিসির এই বৈঠক প্ল্যাটফর্মটি পরিচালনার জন্য ৩২ জিবি র্যাম ও ১৬ কোর প্রসেসরের ১৫টি সার্ভার ব্যবহৃত হচ্ছে। সব মিলিয়ে যার বাজারমূল্য আনুমানিক ৩ লাখ টাকা।
সিনেসিস আইটিকে নতুন ‘ইউনিফায়েড কমিউনিকেশন টুল’ প্ল্যাটফর্ম তৈরির কার্যাদেশ :
বিসিসির নিজস্ব প্রকৌশলীরা যে প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করেছিলেন এবং যেখানে ব্যবহার ছিল প্রায় শূন্য, সে প্রকল্পে বিপুল অঙ্কের অর্থ অপচয়ের আয়োজন করা হয়েছিল হাসিনা সরকারের আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদের মাধ্যমে। বৈঠকের সক্ষমতা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ না নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন করে আরও একটি ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্ম তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয় ‘ইউনিফায়েড কমিউনিকেশনস টুল’ নামে এজ প্রকল্পের আওতায়।
একই ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে সিনেসিস আইটি :
সিনেসিস আইটি যে প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করছে, সেটি আসলে বিসিসির পুরোনো ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্মেরই সংস্করণ। প্ল্যাটফর্মটির বাহ্যিক রঙ ও লোগো পরিবর্তন করে এবং নতুন কিছু ফিচার যোগ করে হস্তান্তরের প্রস্তুতি চলছে। অর্থাৎ, ৪০.৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নামমাত্র এই প্ল্যাটফর্ম তৈরির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত করা হয়েছিল।
ইউনিফায়েড কমিউনিকেশন প্ল্যাটফর্মের সক্ষমতা প্রশ্নে ধোঁয়াশা :
সিনেসিস আইটি কর্তৃক ইউনিফায়েড কমিউনিকেশন প্ল্যাটফর্ম নামে যে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হচ্ছে, এর বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্ল্যাটফর্মটির মাধ্যমে ৫০০-১০০০ ব্যক্তি একসঙ্গে ৫০০টি মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতে পারবেন বলে দাবি করা হলেও বিসিসির কাছে প্ল্যাটফর্মটি ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য নেই পর্যাপ্ত হার্ডওয়্যারের সক্ষমতা।
দরপত্রের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১০০০ জন একসঙ্গে ৫০০ মিটিং পরিচালনার জন্য বিসিসিকে নিজস্ব খরচে এক লাখের বেশি ভার্চুয়াল মেশিন ক্রয় করতে হবে, অর্থাৎ নতুন করে শুধু এই প্ল্যাটফর্ম পরিচালনার জন্যই অন্তত ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ডেটা সেন্টার স্থাপন করতে হবে। এ অবস্থায় দরপত্রে প্ল্যাটফর্মটির সর্বোচ্চ সক্ষমতা পরীক্ষা করে হস্তান্তরের শর্ত থাকলেও কার্যত কোনো ধরনের পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা ছাড়াই এটি বিসিসির কাছে হস্তান্তর করা হবে। যেখানে বৈঠক প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার শূন্যের কোঠায়, সেখানে শতকোটি টাকার ডেটা সেন্টার করে ইউনিফায়েড কমিউনিকেশন টুল-এর নামে নতুন মিটিং প্ল্যাটফর্ম করার বিষয়টি বাস্তবসম্মত নয়।
সিনেসিস আইটি কর্তৃক তৈরি করা এপ্লিকেশনের মেধাস্বত্ব বিসিসির কাছে হস্তান্তর করা হবে না। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চুক্তির মেয়াদ মাত্র তিন বছর, যা পরবর্তী সময়ে প্ল্যাটফর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। তিন বছর পর যদি প্ল্যাটফর্মে কোনো কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয়, বিসিসির প্রকৌশলীদের তা সমাধান করার সক্ষমতা থাকবে না।
প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও সিনেসিস আইটি সোর্স কোড হস্তান্তর করবে না। ফলস্বরূপ প্ল্যাটফর্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিসিসি নিজেও স্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারছে না, যা সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। সুযোগ থাকবে না ভবিষ্যতে এর কলেবর বৃদ্ধিরও; অর্থাৎ ফের সিনেসিস আইটিরই দ্বারস্থ হতে হবে বিসিসিকে।
বৈঠকের কর্মসূচি পরিচালক এবং এজ প্রকল্পের উপপরিচালক আমার দেশকে বলেন, ‘বৈঠকের বর্তমান ভার্সনটি ব্যক্তি, কর্মকর্তা বা মন্ত্রণালয়ের সবক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সাপোর্ট দেওয়ার মতো ছিল না। এর পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের সাপোর্ট দেওয়ার জন্য আরও কিছু ফিচার যুক্ত করার প্রয়োজন ছিল; যেমন একটি হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্ম, যেখানে দেশের ডেটা দেশের মধ্যেই সুরক্ষিত থাকবে। এ ধরনের উদ্যোগ মূলত গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কাজের অন্তর্গত। এই প্রেক্ষাপটে নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্ল্যাটফর্মটি কার্যকর রাখতে হলে নিয়মিত আপডেট এবং নতুন ফিচার যোগ করার ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।’
সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে অপর একটি সূত্র বলছে, ‘এটি তৈরি করলেই সাসটেইনেবল হবে এমনটি নয়। কারণ, প্ল্যাটফর্মটি কার্যকর রাখতে হলে নিয়মিত আপডেট এবং নতুন ফিচার যোগ করতে হবে। কিন্তু ভেন্ডর কর্তৃক তৈরি প্ল্যাটফর্মে সাধারণত নির্ধারিত ফিচারগুলোর বাইরে নতুন কিছু সংযোজন বা আপগ্রেড করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বিশেষত, পরবর্তীতে এটি বিসিসিকে হস্তান্তর করা হলে ফিচার সংযোজন ও রক্ষণাবেক্ষণের চ্যালেঞ্জ আরও বেড়ে যাবে। এ কারণেই বর্তমান বৈঠক প্ল্যাটফর্মটি রিভিউ করে প্রকল্পটি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। কারণ, সরকারি মিটিংয়ের প্রয়োজন মেটাতে টিমস বা জুমের মতো বিদ্যমান প্ল্যাটফর্মগুলো যথেষ্ট কার্যকর। ফলে এত বড় ইনফ্রাসট্রাকচার মেইনটেইন করা ভবিষ্যতে যৌক্তিক নাও হতে পারে।’
মূল রিপোর্ট : আমার দেশ