মোদির বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস, গুমের শিকার হন ৩ জন

কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ২০২০ সালে ভারতের হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে প্রধান অতিথি করার প্রতিবাদে ফেসবুকে লেখালেখি করায় তিন প্রকৌশলীকে গুম করে ভয়াবহ নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ভুক্তভোগী প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন- তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা এবং গুমের সময় অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। গুমের ঘটনায় র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তাকেও শনাক্ত করেছেন তারা।

তিন প্রকৌশলীর মধ্যে মাসরুর আনোয়ার চৌধুরী ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন। আসিফ ইবতেহাজ রিবাত কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মোহাম্মদ কাওসার আলম ফরহাদ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। গুম-সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে এ সংক্রান্ত অভিযোগও জমা দিয়েছেন তারা।

মোদিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি করার প্রতিবাদে প্রকৌশলী মাসরুর আনোয়ার চৌধুরী ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘মোদি ভারতে মুসলিমদের নির্যাতন করে। আর আজ তাকে প্রোটেকশন দিয়ে বাংলাদেশে সম্মান, মর্যাদা, নিরাপত্তা দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে র‌্যাব-পুলিশ। মনে রাখা হবে।’

এর আগের বছরের ২০ অক্টোবর বিএসএফের হাতে নির্মম মারধরের শিকার পাঁচজন র‌্যাব সদস্যের রক্তাক্ত ও ছিন্নবস্ত্রের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে তিনি লিখেছিলেন, ‘এবার বিএসএফ আর ভারতীয় গ্রামবাসী র‌্যাবের পাঁচ সদস্যকে সোর্সসহ পিটিয়ে ১০ ঘণ্টা পর বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে। তারা (র‌্যাব সদস্যরা) মাদকের আসামিকে ধরতে গিয়ে ভারতের সীমান্তে ঢুকে পড়েছিল। পা-চাটা গোলামেরা তাও বলবে ভারত আমাদের বন্ধু। এই ডিবি-পুলিশগুলোই আবার ভারতবিরোধী নিরপরাধ দেশের মুসলিমদের গুম করবে, হত্যা করবে।’

ফেসবুকে ভারতের আধিপত্যবাদ নিয়ে এমন লেখার কারণে মোদি বাংলাদেশে আসার আগেই গুম করা হয়েছিল তিন প্রকৌশলীকে। ভুক্তভোগীরা জানান, তাদের জেএমবি সদস্য সাজিয়ে দিনের পর দিন গুম এবং নির্মম নির্যাতনের পর মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে কুখ্যাত জঙ্গি হিসেবে হাজির করা হয়।

প্রকৌশলী মাসরুর সে দিনের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, ২০২০ সালের ১ মার্চ সকাল সাড়ে ৮টার দিকে হাতিরঝিল পুলিশ প্লাজার পাশে তাকে বহনকারী রিকশাকে আটকায় একটি সাদা মাইক্রো। তাকে রিকশা থেকে নামিয়ে বিভিন্ন ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখিয়ে নাম জানতে চায়। পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিমের একজন অফিসার র‌্যাবের আইডি কার্ড দেখিয়ে বলেন, ‘বুঝতেই তো পারছেন, আমরা কারা? গাড়িতে উঠেন এক্ষুণি, নইলে শুট করব।’

প্রকৌশলী মাসরুরকে তুলে নেওয়ার পর একই কায়দায় অপহরণ করা হয় প্রকৌশলী আসিফ ইবতেহাজ রিবাতকেও। গুমের ঘটনা বর্ণনা করে আমার দেশকে তিনি বলেন, ‘গুলশান-১ সংলগ্ন পুলিশ প্লাজার নিচ থেকে আমাকে তুলে নেওয়ার পর তারা আমার কাছে জানতে চায় আমি কোনো জঙ্গি দলের সদস্য কি না।’

‘তাদের মধ্যে দু-একজন আমাকে পররাষ্ট্র নীতি বোঝানোর চেষ্টা করেন। দেশে কোন রাষ্ট্রপ্রধান আসবেন সেটি নিয়ে আমি কেন (ফেসবুকে) কথা বলব, পররাষ্ট্রনীতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এ বিষয়ে নীতি নির্ধারকরা সিদ্ধান্ত নেবেন। ভারতের মুসলিম হত্যা করা হয় সেটির কারণে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করলে দেশের ক্ষতি হবে। ভারত আমাদের অনেক বড় বন্ধু ইত্যাদি এসব বিষয় তারা আমাকে বোঝাতে থাকে।’

ওই একই টিম গভীর রাতে প্রকৌশলী মোহাম্মদ কাওসার আলম ফরহাদকেও তার বাসা থেকে তুলে নেয়। তিনি বলেন, ‘৩ মার্চ আনুমানিক রাত ১টার দিকে বাসায় নক করে ওরা। দরজা খুলতেই দেখলাম পাঁচ থেকে ছয়জন লোক। আমার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তারা আমার ফোন, মানিব্যাগ, আইডি কার্ড, ক্রেডিট কার্ড সব নিয়ে নেয়। তারা আমার স্ত্রীকে তাদের কাছে অস্ত্র আছে বলে ভয় দেখায়। এরপর তারা আমাকে কালো গ্লাসের একটা মাইক্রোতে চোখ বেঁধে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যায়।’

মোদির বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় র‌্যাবের গুম ঘরে বর্বর নির্যাতন করা হয়েছিল এই তিন প্রকৌশলীকে। নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে প্রকৌশলী মাসরুর বলেন, ‘তুলে নেওয়ার পর আমাকে ছোট একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর এক রক্ষী এসে আবার চোখ বন্ধ করে আমাকে নিয়ে যায় আরেক রুমে। চেয়ারে বসিয়ে হাত এবং পা বাঁধা হয়। হঠাৎ করে দুই পাশ থেকে লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে। আর বলে, তোর সঙ্গে আর কে কে আছে, নাম বল। আমাকে জঙ্গি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা স্বীকার করতে বলে। কিছু নাম বলতে বলে।’

‘পরের দিন চোখ, হাত বেঁধে একটা গাড়িতে তোলা হলো। গাড়ি চলতে লাগল এক অজানা গন্তব্যে। আমি শিওর হলাম যে আমাকে ক্রসফায়ার দিতে নিয়ে যাচ্ছে। পেছনের সিটে বসে হেলান দিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় হালকা ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কোথায় যাচ্ছি আমরা। আনুমানিক এক ঘণ্টা পর গাড়ি থামলে আমি ‘র‌্যাব হেডকোয়ার্টার’ লেখা দেখি।

‘এরপর উপরে নিয়ে চোখ আর হাত খুলে দিলে দেখতে পাই একটা অন্ধকার রুম চারপাশে কালো কাপড়। লাঠি দিয়ে গুঁতো দিয়ে মাথা নিচু করে থাকতে বলল। … এরপর একটা অন্ধকার সেলের দরজা খুলে আমাকে ফেলে যায়। আর বলে যায়, যাতে নাড়াচাড়া না করি। কোনো আওয়াজ না করি।’

প্রকৌশলী মাসরুর বলেন, ‘সাত-আট দিন পর একজন রক্ষী এসে আমাকে, আমার কাপড়-চোপড় দিয়ে বলে এগুলো পরে নে। এরপর গাড়িতে তোলা হলো, আবার গাড়ি চলতে লাগল। এক ঘণ্টা পর গাড়ি থেকে নামানো হলো। আবারও সেই প্রথম দিনের সেলে ঢুকানো হলো। তখনো বুঝতে পারিনি সেই সেলটি কোন জায়গায়।’

প্রকৌশলী ফরহাদ আমার দেশকে বলেন, ‘তারা আমাকে ছোট একটা রুমে চোখ বাঁধা, হাতকড়া পরা অবস্থায় মাটিতে ফেলে রাখল। কিছুক্ষণ পর দুজন এসে নিয়ে গেল আরেক জায়গায়, চেয়ারে বসিয়ে শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ।’

জানতে চায়, ‘হাসিনার সরকারের সঙ্গে আমাদের সমস্যা কী? আমরা নাকি হাসিনাকে উৎখাত করতে চাই…। এসব অভিযোগ অস্বীকার করার পর শুরু হলো দুই পাশ থেকে দুজনের লাঠির আঘাত। পিঠে, দুই হাঁটুতে এবং দুই বাহুতে চলতে থাকে লাঠির আঘাত। আমি জানি না তারা আমাকে কতক্ষণ মারছে। আমি শুধু প্রথম আঘাতেই ব্যথা পাইছি। এরপর কী হয়েছে আমি জানি না।’

‘এভাবে প্রায় দুই থেকে তিন দিন এই জায়গাতে ছিলাম গুম অবস্থায়, কখন দিন হচ্ছে কখন রাত হচ্ছে কিছুই জানি না। এ সময় প্রায় প্রতি রাতেই তারা জিজ্ঞাসাবাদের নামে কখনো পিটিয়েছে, কখনো মানসিক টর্চার করেছে। ক্রসফায়ারের ভয়, নখ তুলে নেওয়ার ভয়, ইলেকট্রিক শকের ভয়। শুধু এটা স্বীকার করার জন্য যে আমরা কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত।’

তিনি জানান, ‘এরপর এক রাতে কয়েকজন এসে বলল, নে কাপড়-চোপড় পরে নে। বাইচা গেছস। এই বলে তারা আবার আরেকটা গাড়িতে তুলল। চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা, হাতকড়া পরানো। মনে হচ্ছিল আজকে তারা আমাকে মেরে ফেলবে। গন্তব্য আরেক জায়গা, পরে জানলাম সেটা র‍্যাব-১১ নারায়ণগঞ্জ। সেখানেও প্রতি রাতে চলল মানসিক টর্চার। ফেসবুক আইডিতে ঢুকে বিভিন্ন স্ট্যাটাস দেখে দেখে চলত মানসিক নির্যাতন।

তিনি বলেন, আটকের পর তারা তাকে ও প্রকৌশলী ফরহাদকে র‌্যাব-১ এর কার্যালয়ে নিয়ে আসে এবং একটি ভবনের দ্বিতীয় তলাতে নিয়ে রাখে। সেখানে ৩ থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত তাদের রাখা হয়। এরপর ৫ তারিখ রাতে আমাদের র‍্যাব-১ থেকে নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত র‍্যাব-১১ তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের বাকি সময় রাখা হয়।

এদিকে, গুম ঘরে দিনের পর দিন রেখে নির্যাতনের পর এই তিন প্রকৌশলী ও তাদের সঙ্গে আরেক আলেমকে নিয়ে গ্রেপ্তারের নাটকও ছিল বেশ চাঞ্চল্যকর। তিন প্রকৌশলী মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হন।

প্রকৌশলী মাসরুর বলেন, ২০২০ সালের ৬ মার্চ রাত ১২টার পর একটা কালো মাইক্রোবাসে করে আমাদের তিনজনসহ আরেকজন অপরিচিত এক হাফেজকে নিয়ে একটা গাড়িতে করে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে সাইনবোর্ড এলাকায় নিয়ে একটা গোপন বৈঠকের নাটক সাজায় র‌্যাব। আমরা গাড়িতে বসা ছিলাম। হঠাৎ শুনলাম হইহুল্লোড় করে কয়েকজন পাঞ্জাবি পরা লোক আমাদের গাড়িতে উঠছে। বাইরে ‘এই জঙ্গি ধর, জঙ্গি ধর’ ‘এই ধর ধর’ এমন চিৎকার, হুড়াহুড়ির শব্দ শুনতে পাই।’

‘আমি শুনতে পাই আমাকে নিয়ে আসা লোকেরা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ধর ধর, গাড়িতে উঠা এসব বলে চিৎকার করছে। গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে এরপর বাইরে থেকে একজন আমাদের কাছে আমার নাম, পরিচয় জিজ্ঞেস করে। তাদের কাছে এসব তথ্য আগে থেকেই থাকার পরও তারা ওই সময় গাড়ির ভেতর আটকে রেখে বাইরে থেকে নাম, বাবার নাম, ঠিকানা এসব জানতে চায়। পরে বুঝলাম এটা একটা নাটক, যেখানে আমাদের বলি দেওয়া হচ্ছে। এরপর আবার র‍্যাব-১১ এর সেলে সেই রাতেই নিয়ে যায়।’

‘পরের দিন সকালে সব গণমাধ্যম ডেকে নিউজ করল- আমরা নাকি গোপন জঙ্গি বৈঠক করেছি হাসিনাকে উৎখাতের জন্য। সব গণমাধ্যমে নিউজ করাল। আমাদের কাছে থেকে নাকি বিপুলসংখ্যক জিহাদি বই পাওয়া গেছে। যথারীতি সারা দেশের মানুষের কাছে আমাদের জঙ্গি হিসেবে প্রচার করল। এরপর ফতুল্লা থানায় নিয়ে গিয়ে কোর্টে তুলল সন্ত্রাসবিরোধী ধারায় মিথ্যা মামলা দিয়ে।’

প্রকৌশলী মাসরুর বলেন, ‘র‌্যাব-১১-এর দুর্নীতিগ্রস্ত কয়েকজন কর্মকর্তা প্রমোশনের জন্য, টাকার জন্য, এসব করে বেড়াত। বিদেশিদের ওরা খুশি করার জন্য মিথ্যা জঙ্গি নাটক সাজাতো। আর সরকার থেকে পদক পেত। এই ব্যক্তিরাই শত শত নিরপরাধ মানুষকে গুম করে নির্যাতন করেছে। পরে জঙ্গি মামলা দিয়ে বছরের পর বছর জেল খাটিয়েছে। এদের অত্যাচার থেকে নারীরা পর্যন্ত রক্ষা পায়নি। ওরা নারীদেরও গুম করত, টর্চার করত এবং মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে এ দিত।’

গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) একেএম শহিদুল রহমান বলেছেন, ‘র‌্যাবের আয়নাঘর ছিল ও আছে। গুম কমিশন তদন্ত করছে।’

র‌্যাবের বিরুদ্ধে ওঠা গুম ও খুনের বিষয়ে ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে র‌্যাব ডিজি বলেন, ‘সবকিছু সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে আমরা দায়মুক্ত হতে চাই। এটার বাইরে দায়মুক্তির সুযোগ নেই।’

এই বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শেখ ওমর বলেন, স্বৈরাচারের আমলে এ ধরনের অনেকগুলো গুমের ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভোগীরা চাইলে এখনো গুমের সঙ্গে জড়িত র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। মামলা করার ক্ষেত্রে বিলম্বজনিত কারণে ফৌজদারি অপরাধ কখনো তামাদি হয় না। যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে সেই এলাকার থানায় অথবা ওই এলাকার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ভুক্তভোগীরা মামলা করতে পারবেন।

মূল রিপোর্ট : আমার দেশ