কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :
‘ঢাকার নিউমার্কেট-সংলগ্ন পিলখানা গেটে ৬০ সদস্যের সেনাদল নিয়ে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সকাল ১০টা ২০ মিনিটে প্রথম পৌঁছি। কিন্তু আমাদের ঢুকতে না দিয়ে থামিয়ে দেওয়া হয়। উপর থেকে নির্দেশ আসে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে। ফায়ার ওপেন করা যাবে না।
২৫ ফেব্রুয়ারি পুরো দিন ও রাত এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি দিনশেষে গভীর রাতে আমাদের ঢুকতে দেওয়া হয়। অন্ধকার পিলখানায় ঢুকে দেখতে পাই এক নারকীয় দৃশ্য। ৩৯ জন শহীদ সেনা অফিসারের ডেডবডি পাই ৮ ফুট বাই ৬ ফুট গর্তে। গুলিতে এবং বেয়নেট চার্জে হত্যা ছাড়াও কয়েকজনকে গাড়ির চাকায় পিষ্ট করে মারা হয়েছে। তাদের জিহ্বা বের হয়ে আছে। ডিজি মেজর জেনারেল শাকিলের ডেডবডিতে দেখলাম পাঁচটি গুলির চিহ্ন, বেয়নেট চার্জে পেটের এক পাশের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আছে। স্যারের পরনে শুধু গেঞ্জি ও আন্ডার ওয়্যার, রক্তে লাল হয়ে আছে। ফজরের আজান হচ্ছে।
ডিজির বাসভবনের সামনে গিয়ে আঁতকে উঠলাম। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আবছা আলোতে দেখলাম ছোপ ছোপ রক্তের মাঝেই চেয়ার পেতে বসে আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, ফজলে নূর তাপস, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ এবং ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাকিম।
তারা হাসিখুশি স্বাভাবিক কথাবার্তা বলছিলেন। আমাদের দেখেই কমান্ডার চেয়ার থেকে উঠে এসে বললেন- ‘তোমরা যে আমাদের দেখেছ, কাউকে বলার দরকার নেই, বুঝতে পেরেছ? বিডিআর জওয়ানরা যারা পালাতে পারেনি, তাদের বাইরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও, পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।’
চাঞ্চল্যকর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক এই বর্ণনা দেন সেনাবাহিনীর ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের ৪ ফিল্ডের তৎকালীন কর্মকর্তা মেজর অবসরপ্রাপ্ত জসিম। প্রত্যক্ষদর্শী এই কর্মকর্তার নেতৃত্বেই ৬০ সদস্যের সেনাদল সেদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ২০ মিনিটে নিউমার্কেট-সংলগ্ন বিডিআর গেটে প্রথম পৌঁছে অবস্থান নিয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী মেজর জসিম বলেন, সেদিনের পিলখানার ঘটনা বিডিআর বিদ্রোহ ছিল না, ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। সেই দিনগুলোতে পিলখানায় অবস্থান করে এবং নানা আলামত সংগ্রহ ও অবলোকন করে আমি নিশ্চিত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পনা এবং প্রতিবেশী গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী এবং বিডিআরকে দুর্বল করাই ছিল লক্ষ্য।
মেজর জসিম বলেন- সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, পিলখানায় ঢুকে সে রাতে আমরা উদ্ধার করি বিডিআরের ২০ থেকে ২৫ জোড়া নতুন পোশাক যা কিলিং গ্রুপ ফেলে গেছে বলে জানতে পেরেছি। সেখানে পেয়েছি সিলিং ও হেভার শেক যা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। যে বেল্ট পাওয়া গেছে তা আমাদের কোনো বাহিনীতে ব্যবহার করা হয় না। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, কোয়ার্টার গার্ডের সব আর্মস ও গোলাবারুদ বিডিআর জওয়ানরা ব্যবহার করেছেন, কিন্তু এআইও ক্যাপ্টেন জিয়াকে নিয়ে পিলখানায় রিজার্ভ অস্ত্রাগারে ঢুকে দেখি সবকিছু এলোমেলো।
গ্রেনেড কখনো প্রাইম করা থাকে না। গ্রেনেডের বডি এবং ডেটোনেটর সম্পূর্ণ আলাদাভাবে সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু আমরা দেখলাম, উলটো চিত্র। প্রাইম করা গ্রেনেড ছিল জওয়ানদের কাছে। আমরা নিশ্চিত ১৫/২০ দিন আগে থেকে দক্ষ কাউকে দিয়ে এগুলো করানো হয়েছে। গোলাবারুদের বক্স খোলা, শত শত ক্লিপ ও ড্রামে গোলাবারুদ ছড়ানো। এসব দেখে আমরা হতবাক হয়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গেই আমার অধিনায়ককে জানাই এবং আলামত যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য ২৪ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা করি।
মেজর জসিম বলেন, পিলখানার ঘটনার প্ল্যানিং থেকে সাকসেসফুল এক্সিকিউশন পর্যন্ত সবকিছু দক্ষভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। এর সঙ্গে শেখ হাসিনা ছাড়াও জড়িত সন্দেহভাজনদের মধ্যে আছেন মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিক, লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, সাহারা খাতুন, শেখ সেলিম, ফজলে নূর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এবং আবদুর রাজ্জাক (সাবেক খাদ্যমন্ত্রী)।
তিনি আরো বলেন, পিলখানায় ৫৭ সামরিক কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন হত্যার অভিযানে সফলতা এনে দেওয়ার জন্য দায়ীদের মধ্যে অবশ্যই আছেন জেনারেল (অব.) মঈন ইউ আহমেদ (সাবেক সেনাপ্রধান) ও মেজর জেনারেল (অব.) মঈনুল ইসলাম, কর্নেল শামস, কামরুজ্জামানসহ (সাবেক বিডিআর ডিজি) কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা, যারা আমাদের কোনোরূপ দিকনির্দেশনা বা অপারেশনাল অর্ডার না দিয়ে বিপুলসংখ্যক অফিসারকে হত্যার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে লাল রক্ত উপহার দিয়ে গত ১৬ বছর পদোন্নতিসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দেশে-বিদেশে কলঙ্কিত করেছে।
সেদিন বিডিআর গেটে পৌঁছামাত্র আমাদের ঢুকতে দেওয়া হলে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারত না। তিনি জানান, বিডিআরের ঘটনা তদন্তের জন্য কমিশন হয়েছে। কমিশন ডাকলে সেখানে গিয়ে সবিস্তারে আমার দেখা ও জানা বিষয়গুলো বলব।
পিলখানায় প্রথম সেনাদল ও সিও’র কল :
পিলখানায় যাওয়ার ঘটনা সম্পর্কে মেজর (অব.) জসিম জানান, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৬টার মধ্যে আমাদের মিরপুর সেনানিবাস থেকে সেনাকুঞ্জের চারদিকে পজিশন নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কারণ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ উপলক্ষে আসবেন এবং দুপুর ৩টায় আমরা তাকে সেনাকুঞ্জে গার্ড অব অনার জানাব। এ জন্য দুদিন সম্পূর্ণ রেকি করে আমাদের সেনাদল সেখানে তৈরি ছিল।
পিলখানা ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার আমাদেরকে পিলখানায় যেতে আদেশ করেন যেহেতু আমরা অস্ত্রেশস্ত্রে তৈরিই ছিলাম, সে কারণে। আমি, মেজর (অব.) জসিমের নেতৃত্বে ৬০ জনের দলটি নিয়ে নিউমার্কেট-সংলগ্ন পিলখানার গেটে পৌঁছি ১০টা ২০ মিনিটে। আমরা গেটের ১৫০ থেকে ২০০ গজ দূরত্বে থাকা অবস্থায় আমাদের সেখানেই অবস্থান করতে বলা হয়। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম বিপথগামী বিডিআর জওয়ানরা এলোমেলো ও বিভিন্ন দিকে দৌড়াদৌড়ি করছে।
গেট দিয়ে অনেক জওয়ান ও সিভিল লোকজন বের হয়ে যাচ্ছে। আর্মি ঘিরে ফেলেছে দেখে তারা অনেকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আমরা তাদের মুভমেন্ট পর্যবেক্ষণ করছিলাম। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো দিকনির্দেশনা পাইনি। অধিনায়ককেও পরিস্থিতি অবহিত করে আদেশ পাচ্ছিলাম না। এক ঘণ্টার মধ্যে আদেশ না পেয়ে বিএম ৪৬ ব্রিগেডের সঙ্গেও যোগাযোগ করি। সেখান থেকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। বিডিআর জওয়ানরা আর্মি দেখে অস্ত্র নিয়ে ফায়ার করতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যে ৬০ মি.মি. মর্টার এক বা দুটি বসিয়ে মর্টার ফায়ার শুরু করে। কিছু মর্টারের শেল নিউমার্কেটের দিকটায় যায়।
গেটে ঢোকার অর্ডার না পাওয়ায় ছটফট করছিলাম। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। সাড়ে ১১ থেকে ১২টার মধ্যেও আদেশ পেলে পিলখানার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ সেনাবাহিনীর দখলে চলে আসত। কারণ তখনো বিডিআর জওয়ানদের তেমন প্রস্তুতি ছিল না। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকালে ৩/৪ জন সিভিল লোককে দেখে চোখ একেবারে আটকে যায়। দুজনকে চিনতে অসুবিধা হয়নি। তারা জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম। বিডিআর গেটের ভেতর জওয়ানদের জড়ো করে কিছু একটা বলছিলেন। হঠাৎ আমার মোবাইলে সিও স্যারের কল। ভাবলাম হয়তো অ্যাকশনে যাওয়ার আদেশ। কিন্তু আমাকে বলা হলো, ‘কোনো ফায়ার ওপেন করা যাবে না, নিরাপদ দূরত্বে চলে যাও।’ তখন বুঝতে আর বাকি রইল না কী হতে যাচ্ছে!
পিলখানায় দেখলাম নারকীয় দৃশ্য, ৫৭ সেনা কর্মকর্তার লাশ :
মেজর জসিম বলেন- ২৫ ফেব্রুয়ারি ডিজিসহ ১৬ থেকে ১৮ জন অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। বিডিআর জওয়ানদের সঙ্গে যারা কিলিং মিশনে অংশ নিয়েছিল, তারা ২৬ ফেব্রুয়ারি দিনের আলোতেই আরো নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়। সেদিনই প্রায় সব অফিসারকে হত্যা করা হয়। ২/৩ জন অফিসার কোনোভাবে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তারপরও আমরা পিলখানায় ঢুকি এবং নিউমার্কেট-সংলগ্ন গেট ও জিগাতলা গেটের দায়িত্ব গ্রহণ করি। আমি এবং ১০ ইস্ট বেঙ্গলের একজন অফিসার দুজনে মিলে অন্ধকারে এবং কিছু আবছা আলোতে পিলখানা চত্বরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা অস্ত্র, গোলাবারুদ ও গ্রেনেড দেখতে পাই। বেশকিছু গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাও দেখতে পাই। আমরা লাশ খুঁজতে থাকি।
এরই মধ্যে ফজরের আজান হয়। ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল স্যারের বাসভবনের সামনে গিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনসহ অন্য যাদের দেখেছি সে বর্ণনা আগেই দিয়েছি। মেজর জসিম বলেন, আমি সর্বপ্রথম ৩৯ জন শহীদ অফিসারের ডেডবডি ৮ ফুট বাই ৬ ফুট গর্তে আবিষ্কার করি। আমি হন্যে হয়ে লাশ খুঁজতে গিয়েই এই গণকবর পাই।
বিডিআর হাসপাতালের পাশে মরচুয়ারি-সংলগ্ন কাঁঠাল গাছের নিচে নতুন মাটি দেখি এবং শুকনো পাতা দিয়ে ঢেকে রাখা উঁচু জায়গা দেখে আমার সন্দেহ হয়। তখন সৈনিকদের ডেকে জায়গাটি পরিষ্কার করি। শুকনো পাতা ও আবর্জনা পরিষ্কার করার পর নিশ্চিত হলাম এই গর্তটিই গণকবর। সৈনিকরা কোদাল ও বেলচা দিয়ে আস্তে আস্তে মাটি সরাতে থাকে যাতে লাশের কোনো ক্ষতি না হয়। দেখতে পেলাম অসংখ্য লাশ। সৈনিকদের কিছু কম্বল আনতে বললাম। এরপর লাশ উঠাতে থাকলাম। গর্তের মাটি সরানোর পর দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল।
সবাই মুখে রুমাল দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি এতটাই মর্মাহত হয়ে পড়ি যে, আমার নাকে দুর্গন্ধ লাগছিল না। কাঁদছিলাম এবং ডেডবডিগুলো উঠাচ্ছিলাম। তাদের নাম লেখার দায়িত্ব দিই একজন সৈনিককে। গুলি, বেয়নেট চার্জ ছাড়াও অনেক অফিসারকে গাড়ির নিচে ফেলে মারা হয়েছে। তাদের জিহ্বা বের হয়ে আছে যা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়।
শেষ ডেডবডিটা হলো ডিজি স্যারের। পরনে শুধু একটা আন্ডার গার্মেন্ট ও সাদা গেঞ্জি যা রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। ডিজি স্যারের শরীরে পাঁচটি গুলির চিহ্নসহ বেয়নেট চার্জ করায় পেটের একপাশে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আছে। সব লাশ তোলার পর নামের তালিকা নিয়ে আমি সোজা জিগাতলা গেটে যাই এবং অপেক্ষমাণ পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে নামগুলো পড়ে শোনাই। সেদিন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সেটা লাইভ প্রচার হয়েছিল।
মেজর জসিম জানান- গর্ত (গণকবর) থেকে আমরা উদ্ধার করি ৩৯ জনকে। পিলখানার বিভিন্ন স্থানে হত্যার শিকার হয়ে পড়ে থাকা ১১ জন অফিসারের লাশ, ড্রেনে ফেলে দেওয়ার পর বুড়িগঙ্গা নদীতে ভেসে ওঠে পাঁচ জন অফিসারের লাশ এবং দুজন অফিসার মেজর গাজ্জালী ও ক্যাপ্টেন তানভীরকে হত্যা করে প্রাইভেটকারের ভেতরে রেখে সম্পূর্ণ গাড়িটি পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়। এই ৫৭ অফিসার ছাড়াও মোট ৭৪ জনের লাশ পাওয়া যায়।
লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও পৈশাচিক অত্যাচার :
মেজর জসিম জানান- পিলখানায় ঢুকে আমরা আরো জানতে পেরেছি এবং আলামত দেখেছি যে, প্রতিটি অফিসার্স ভবনে লুটতরাজের পর নানাবিধ অসামাজিক কার্যকলাপ করা হয়েছে। বিপথগামী বিডিআর জওয়ানরা হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ এবং এত পৈশাচিকতা চালায়, যা ছিল নজিরবিহীন। দেখলাম অফিসারদের গাড়িগুলো আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সেখানে বিভিন্ন ভবন ও চত্বরে ছড়ানো-ছিটানো অবিস্ফোরিত গ্রেনেড এবং হাজার হাজার কার্টিজ এবং লাইফ অ্যামুনেশন দেখতে পেয়েছি। বিডিআরের পোশাক এবং ভিন্ন দেশের সরঞ্জাম পাওয়ার কথা আগেই বলেছি। পিলখানার ভেতরে অবস্থানরত ফ্যামিলি ও মেসে অবস্থানরতদের ওপরও নৃশংস অত্যাচার চালানো হয়েছে। এডিসি মেজর মাজহারের পরিবারের ওপরও পৈশাচিক অত্যাচার চালানো হয়।
পিলখানার পুকুরে ফেলা অস্ত্র :
পিলখানার ভেতরে পুকুরগুলোর পানি সেচে সেখানে ফেলে দেওয়া অস্ত্রগুলো আমরা উদ্ধার করি। পিলখানা অফিসের সামনে জিগাতলা গেটের কাছে তিনটি সেচ কল বসিয়ে সব পানি সরিয়ে আমরা উদ্ধার করি ৯৮টি এসএমজি, ৩টি এলএমজি, সঙ্গে ক্লিপ ও ড্রামভর্তি অ্যামুনেশন যা তদন্তের অ্যাক্সিভিটস হিসেবে কোয়ার্টার গার্ডে রাখা হয়। সুইমিংপুলের পানি সরিয়ে দুটি এসএমজি ও তিনটি গুলিভর্তি ম্যাগাজিন পাই।
ডিজির ভবন এবং অফিসার্স কোয়ার্টার ও কোয়ার্টার গার্ডের ধ্বংসাবশেষ থেকেও পরিত্যক্ত অস্ত্র এবং গোলাবারুদ আলামত হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। সিসি ক্যামেরার ফুটেজও সংগ্রহ করে তদন্তের জন্য রাখা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বিডিআর ডিজি মঈনুল হোসেনের সময় এসব আলামত নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে বলে জানতে পেরেছি।
তোপের মুখে ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার :
২৭ ফেব্রুয়ারি ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার পিলখানায় আসেন। সকাল ১০টায় শহীদ কর্নেল মুজিবের স্ত্রী আমাদের সম্মানীয় ভাবী অফিসার্স মেসের সামনেই তার ওপর প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বারবার কমান্ডারকে লক্ষ্য করে বলতে থাকেন, ‘ইউ আর কিলার, ইউ হেভ কিল্ড মাই হাজবেন্ড।’ কর্নেল মুজিব ও এনায়েতের লাশ প্রথম ড্রেন দিয়ে ভেসে আসে। তোপের মুখ থেকে আমরা কমান্ডারকে একটি রুমে সরিয়ে নিয়ে যাই।
আমার ব্রিগেড কমান্ডারকে সম্মান রেখেই আজ বলতে চাই- ৪৬ স্বতন্ত্র ব্রিগেড হলো ঢাকার হার্ট। এ ধরনের বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব ৪৬ ব্রিগেডের। কিন্তু সেদিন সবকিছু নিয়ে অর্থাৎ এপিসি, ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এসেও কেন আমরা পিলখানায় ঢুকতে পারলাম না? ধানমন্ডি আবাহনী মাঠে সমরাস্ত্র প্রদর্শনী ছাড়া আমরা কী করতে পেরেছি? আবাহনী মাঠ থেকে কতটুকু দূরত্ব জিগাতলা বিডিআর গেট? কেন আমাদের অভিযান চালাতে দেওয়া হলো না? কমান্ডারের আদেশের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম ২৫ ফেব্রুয়ারি সারাদিন সারারাত।
২৬ ফেব্রুয়ারি সারাদিন ও গভীর রাত পর্যন্ত। আদেশ কেন এলো সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর? সেটি ছিল ইতিহাসের করুণতম অধ্যায়। আজও ভেবে পাচ্ছি না কেন ও কী কারণে নিশ্চুপ থাকলেন তারা?
লাশ গুমের চেষ্টা :
মেজর জসিম বলেন- আরেকটি কথা না বললেই নয়। আমি যখন গণকবর অর্থাৎ ৮ ফুট বাই ৬ ফুট গর্ত থেকে সেনা কর্মকর্তাদের ৩৯টি অর্ধগলিত লাশ বের করলাম, তখন কমান্ডার বললেন, ব্রিগেড থেকে তিন টনি তিনটি ট্রাক এনে লাশগুলো দ্রুত সরাতে হবে। কমান্ডার স্যার ডিজি শাকিল স্যারের মরদেহ চিনতে পারছিলেন না।
হায়রে কপাল! কী বলব, কী লিখব, ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। কমান্ডার স্যার তো ডেডবডিগুলো গুম করে দিতে চাচ্ছিলেন। আমি যদি জিগাতলা বিডিআর গেটে গিয়ে তালিকাটি পড়ে না শোনাতাম, হয়তো লাশগুলো গুম হয়ে যেত। পরে অবশ্য এই লাশগুলো সিএমএইচের মরচুয়ারিতে নেওয়া হয়।
মঈনুল এলেন :
মেজর জসিম জানান- ২৮ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় ঘটে যাওয়া ক্ষত ও বীভৎসতার বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে আসে। সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী রেসকিউ অ্যান্ড চার্জ অপারেশন নামে কয়েকটি ইউনিটের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। ওইদিন সকাল ১০টায় এয়ারফোর্সের একটি স্টাফ কার জিগাতলার গেটে এসে ঢোকার চেষ্টা করে। ডিউটিরত সেনারা পরিচয় না দেওয়ায় এটি ঢুকতে দেয়নি। সৈনিকরা এসে আমাকে জানালে গাড়ির কাছে যাই।
তখন নির্দেশ ছিল কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবে না। সিভিল ড্রেসে যিনি গাড়ি থেকে নামলেন, পরিচয় দিলেন তিনি নতুন ডিজি মেজর জেনারেল মঈনুল। স্যার আমাকে পরিচয়টা কাউকে না জানাতে বললেন। গাড়িটি গেটের কাছে পিলখানায় পার্ক করতে বলি। স্যারকে ভেতরে নিয়ে যাই। প্লাস্টিক চেয়ারে বসে তিনি বিভিন্ন বিষয় জানতে চান। এক পর্যায়ে ভেতরটা ঘুরে দেখবেন বলে জানান। সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে মঈনুল স্যার বিডিআরের অফিসারদের বাসভবন, ডিজির বাসভবন, অফিসার্স কোয়ার্টার ও বিভিন্ন এরিয়া দেখেন।
শহীদ কর্নেল মুজিবের বাসায় আমরা গেলাম। ভেতরে ঢু্কেই থমকে যাই। কারণ সেখানে দেখতে পাই অবিস্ফোরিত অসংখ্য আর্জেস-৮৪ গ্রেনেড ছড়ানো-ছিটানো। দোতলায় গিয়ে দেখি বাসভবনের সব লুটপাট হয়ে গেছে। গ্রেনেড ছুড়ে ভবনটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। মঈনুল স্যার বললেন, তিনি আর কিছু দেখবেন না। বিডিআর ম্যাসাকারের যত আলামত সংরক্ষণ করা হয়েছিল, নতুন ডিজি মঈনুল স্যার এসে সবই নষ্ট করে ফেলেছেন বলে পরবর্তী সময়ে জানতে পারি।
১৩৪ সেনা কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতি :
মেজর জসিম জানান- ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানার নৃশংস হত্যাকাণ্ডে শহীদ অফিসারদের ব্যাপারে কথা বলার জন্য সেনাকুঞ্জ দরবারে ১ মার্চ ২০০৯ এসেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই দরবারে আমাকে যেতে দেওয়া হয়নি।
দরবারের ব্যাপারে আমাকে আগে জানানো হয়নি। আমি দরবারের কথা জানার পর সেখানে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানালে অধিনায়ক সেনাকুঞ্জের তালিকা থেকে আমার নাম বাদ দিয়ে পিলখানায় থাকতে বলেন।
ওই দরবারে শেখ হাসিনার সামনে শহীদ সহকর্মীদের ব্যাপারে সেনা কর্মকর্তারা বিভিন্ন আবেগময় প্রশ্ন করেছিলেন। এরপর ১৩৪ জন সামরিক কর্মকর্তাকে তালিকা করে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
বিডিআর ম্যাসাকারের অনেক ঘটনার সাক্ষী আমি। এ কারণে আমাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়। ব্রিগেড কমান্ডার এবং সিও’র কাছে আমি এমনই বোঝা হয়ে পড়েছিলাম যে, সব সময় আমাকে মানসিক টর্চারের মধ্যে রাখা হতো।
পিলখানার ঘটনার পরে আমাকে ৬ থেকে ৮ মাসের মাথায় বাংলাদেশের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে বদলি করা হয়নি। আমাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। আমার সহকর্মীরা উচ্চপদে পদোন্নতি পেলেও আমাকে মেজর পদ থেকেই অবসরে যেতে হয়েছে।
আমার প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। স্টাফ কলেজের জন্য উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি আমাকে ছোট্ট একটি ফ্ল্যাট থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে আমি হার্ট অ্যাটাকের সম্মুখীন হই। আমার হার্টে ও চোখে পাঁচটি অপারেশন হয়েছে।
মূল রিপোর্ট : আমার দেশ