কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :
ঈদুল ফিতর আসন্ন। ইতোমধ্যে বাস, ট্রেন ও নৌপথে অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। তবে প্রতি বছরই নিরাপদ ঈদযাত্রা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় যানজট, তবে এবার ঈদযাত্রায় সবচেয়ে বড় শঙ্কা মহাসড়কে গণছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা।
সম্প্রতি গত কয়েক মাসে মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও যাত্রীবাহী বাসে বেশ কয়েকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ভুয়া র্যাব ও ডিবি পরিচয়ে চালকদের কাছ থেকে পণ্য লুট করার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া যাত্রী সেজে বাসে ওঠে ডাকাতি করার ঘটনা ঘটছে।
এবারের ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে হাইওয়ে পুলিশে নতুন করে ৭০০ জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া ১৪৪৩ জন ডাকাতের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে অভিযান চলছে।
হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, মহাসড়কে বর্তমানে ৩০০ টহল টিম কাজ করছে এবং ঈদ যাত্রা শুরু হলে টহল টিমের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে।
তবে মহাসড়কে চলাচলের বড় বাধা হিসেবে দেখছেন সিএনজি, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এবং লক্করঝক্কর বাস। এছাড়া মহাসড়কের ওপরে ১৩৯টি হাট-বাজার অপসারণ করা না হলে যান চলাচলে সমস্যা হতে পারে।
হাইওয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, পুলিশ যদি মহাসড়কে আগামী ১০ দিন কোনও যানবাহন না আটকায় তাহলে কি হবে? আমাদের নিশ্চিত করা হোক, ঈদযাত্রায় মহাসড়কে লক্করঝক্কর বাস নামবে না। কিন্তু এখানে কারো সহযোগিতা পাচ্ছি না।
ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১০৪টি ক্রসিং রয়েছে এবং অবৈধভাবে ১৩ হাজার সিএনজি ও ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চলাচল করছে। সেগুলো বন্ধ না করলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হবে।
তিনি বলেন, আমরা যদি রিকশা ধরি, বলে কেন ধরলেন? বলি—অর্ডার আছে। অর্ডার দেখে বলে ৫ আগস্টের আগের অর্ডার মানি না, নতুন স্বাধীন দেশ হয়েছে, নতুন অর্ডার লাগবে। এই হলো মহাসড়কের অবস্থা।
যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করলে পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব জানিয়ে হাইওয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, সারাদেশে মহাসড়কগুলোর পাশে অন্তত ১৩৯টি হাট-বাজার আছে। এই হাট-বাজার অপসারণ করতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশের পক্ষে এককভাবে উচ্ছেদ বা অপসারণ সম্ভব না। কারণ মহাসড়কের পাশে হাট-বাজার পুলিশ ইজারা দেয় না, নিয়ন্ত্রণও করে না। উচ্ছেদ করতে গেলে শুনতে হয় ‘ইজারা নিয়ে আসছি’।
ঈদযাত্রায় যেন লক্করঝক্কর বাস চলাচল না করে সেজন্য ব্যবস্থা নিতে বিআরটিএ ও পরিবহন মালিক শ্রমিকদের অনুরোধ জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।
এ বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, মহাসড়কে আনফিট বাস ধরলে সরানো ও রাখার জায়গা লাগে। আমরা বিআরটিএকে অনুরোধ করছি, আনফিট বাসগুলোর মালিকদের নোটিশ দেওয়া হোক। এছাড়া এবার আগে থেকেই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হোক।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, মহাসড়কে এখনো নছিমন, করিমন, ভটভটি চলে। নতুন যন্ত্রণার নাম ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা। মানুষকে কষ্ট দেওয়া, যানজটে ফেলা, দুর্ঘটনাসহ নিরাপদ চলাচলে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী এসব বাহন। সারা দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির নেপথ্যে এসব পরিবহন দায়ী হলেও দোষ চাপানো হয় বাসে।
তিনি বলেন, একটি সড়কের দেখভালের দায়িত্ব সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের। সড়কে সামনে গর্ত কিন্তু চালক জানে না, সে দেখছে রাস্তা ক্লিয়ার। একটু পর দুর্ঘটনা ঘটলো! দায় কার? চালকের। এটা তো হতে পারে না।
আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, নতুন করে সড়কে ছিনতাই ও ডাকাতির উপদ্রব দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়া, নরসিংদীর ভুলতা, বেলাবো, কাঁচপুর এলাকায় ছিনতাই ও ডাকাতির উপদ্রব বেড়েছে। ছিনতাই, ডাকাতি, দুর্ঘটনা, ভাড়া বৃদ্ধি, টিকিট কালোবাজারি, যাত্রীদের সঙ্গে অশুভ আচরণ, যানজট বিড়ম্বনা, মালামাল লুটের ঘটনায় কিন্তু যাত্রী ও পরিবহন মালিক শ্রমিকরা ভোগেন।
অনেক সময় পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় আনফিট বাস চলে আসে। সুবিধামতো যাত্রী নিয়ে আবার চলে যায়। এ ধরনের বাস সড়কে দুর্ঘটনার শিকার হলে বা বিকল হলে ভয়াবহ সমস্যা তৈরি হয়। ঈদযাত্রায় মহাসড়কে আনফিট বাস নামলে সংশ্লিষ্ট মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ ও প্রশাসনকে অনুরোধ জানিয়েছেন সমিতির মহাসচিব সাইফুল আলম।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এর পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, উপদেষ্টা ও সচিব ফিটনেসবিহীন বাস চলাচল বন্ধে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনা বাস্তবায়নে আমরা ৬৪ জেলায় টিম গঠন করেছি। পুলিশ প্রশাসন, লোকাল মালিক শ্রমিকদের সঙ্গে সমন্বয় করে বিআরটিএ কাজ করছে।
ঈদের ফিরতি যাত্রায় দুর্ঘটনা এড়াতে দক্ষ চালক নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়ে বিআরটিএ পরিচালক বলেন, ঈদের পর কিছু দুর্ঘটনার নেপথ্যের কারণ, চালকের ছুটিতে থাকা। মূল চালকের সহযোগী বা সহকারী বাস চালান। তখন দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে। শ্রমিক ফেডারেশন ও বাস মালিকরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিআরটিএর এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে ৬৪ জেলায় ভিজিলেন্স টিম তৎপরতা চালাবে। যাত্রী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ভিজিলেন্স টিমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। অভিযোগ পাওয়া মাত্র তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোনোভাবেই অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি আমরা ছাড় দেব না।
হাইওয়ে পুলিশে নতুন করে ৭০০ ফোর্স দেওয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক যানবাহনও দেওয়া হয়েছে। একটি অ্যাপস এর মাধ্যমে টহল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অ্যাপস এর নম্বর হাইওয়ে পুলিশেও দেওয়া আছে। চাইলে পরিবহন শ্রমিক, মালিকরা ও যাত্রীরা অ্যাপসে সংযুক্ত হতে পারবেন। তাহলে তারা দেখতে পারবেন হাইওয়ের কোথায় কোথায় পুলিশের পেট্রোল পার্টি আছে। ইতোমধ্যে এ ধরনের সেবামূলক অ্যাপসের কার্যক্রম বিমানবন্দরে চালু করেছে হাইওয়ে পুলিশ।
এদিকে, বিমানবন্দর হয়ে কোনও যাত্রী বিদেশ গেলে বা প্রবাস থেকে ফিরলে তাদেরকে অ্যাপসে সংযুক্ত হয়ে সেবা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।
এ ব্যাপারে হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, অ্যাপসে আমাদের নাম্বারটা দেওয়া আছে। হোয়াটসঅ্যাপে অন করলেই ভুক্তভোগী কিংবা সাহায্যপ্রত্যাশী ব্যক্তি টহল পার্টির অবস্থান জানতে পারবেন। টহল পুলিশও জানতে পারবে যাত্রীর অবস্থান। মফস্বল বা জেলা শহরে যাওয়ার সময় আমরা সেখানকার ডহর পার্টিকে জানিয়ে দেই স্কট করে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
ঈদযাত্রায় ডাকাত-ছিনতাইয়ের বাগড়া থামাতে ২০০৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মহাসড়কে বিভিন্ন ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনার ডাটা অ্যানালাইসিস করে ১৪৪৩ অপরাধীর তালিকা করেছে হাইওয়ে পুলিশ। সেই তালিকা ধরে অভিযান চালানো হচ্ছে। এছাড়া এই তালিকা নিকটস্থ থানা ও জেলা পুলিশকে পাঠানো হয়েছে।
ডিআইজি শফিকুল ইসলাম জানান, ৩ হাজার ৯০০ কিলোমিটার মহাসড়ক সাড়ে তিনশ’র বেশি টহল দল কাজ করছে। ঈদ যত সন্নিকটে আসবে এই টহল সংখ্যা তত বাড়বে। তারা পনেরো মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছাবে।
তিনি জানান, মহাসড়কের নিরাপত্তা ও নিরাপদ যান চলাচল নিশ্চিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৪০০ ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। ১৩৫০ ক্যামেরা চালু আছে। তবে ঢাকা-উত্তরবঙ্গ রুটের সড়কে এখনো আমরা সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করতে পারিনি। এটার জন্য একটা প্রজেক্ট নেওয়ার কথা চলছে। ঢাকা-মাওয়া সড়কে সড়ক কর্তৃপক্ষের স্থাপিত ক্যামেরার সার্ভারে কানেকশন নেওয়ার চেষ্টা করছি। এছাড়া মহাসড়কে ঘুরছে ড্রোন। ড্রোন ব্যবহারে মহাসড়কের কোথায় কী অবস্থা সেটা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে একগুচ্ছ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ঈদযাত্রার বহরে ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন চলাচল কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। রুট ভিত্তিক গতি নির্ধারণসহ রুট পারমিট ছাড়া বাস চলাচল বন্ধ রাখতে হবে।
যানজট ও দুর্ঘটনা কমাতে মহাসড়কে প্যাডেল রিকশা, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, নসিমন-করিমন, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ঈদের ১০ দিন আগে উচ্ছেদ করতে হবে। টোল আদায় ডিজিটাল করা অথবা অতিরিক্ত জনবল নিয়োগের দাবিও জানান তিনি।
মূল রিপোর্ট : ঢাকা পোস্ট