২০২৪। বছরটি বাংলাদেশের ইতিহাসে থাকবে চিরভাস্বর হয়ে। চব্বিশের জুলাই ছিলো- দেশের ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বর জালিম শাসকের বেপরোয়া মসনদ কাঁপিয়ে দেওয়ার মাস। প্রতীকি অর্থে এ মাসকে ধরা হয় ৩৬ দিনের। কারণ- জুলাইজুড়ে তরতাজা হাজারো প্রাণ বিসর্জন দেওয়া আন্দোলন-অভ্যুত্থানের জন্যই পরবর্তী (আগস্ট) মাসের ৫ তারিখ পতন হয় দীর্ঘ ১৫ বছরের ফ্যসিবাদি আওয়ামী লীগ সরকারের। টানা ৩৬ দিনের বিপ্লবের ফলেই প্রায় দেড় যুগ খুনের নেশায় মত্ত থাকা শেখ হাসিনা পালাতে বাধ্য হন, একই সঙ্গে ওইদিন দেশ ছাড়েন তার সন্ত্রাসী দলের খুনি, অর্থ পাচারকারী ও লুটপাটকারী নেতাকর্মীরা। ৬ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তভেজা অন্ধকার তেপান্তর ফুঁড়ে দেশের আকাশে উদিত হয় নতুন স্বাধীনতার লাল সূর্য। সেই উত্তাল জুলাই-আগস্টের দিনগুলোতে কেমন ছিলো সিলেট- এ নিয়ে কওমি কণ্ঠে প্রতিদিন থাকছে বিশেষ প্রতিবেদন।
কওমি কণ্ঠ রিপোর্টার :
চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে সিলেটে ঘটনাবহুল এক দিন ছিলো ১৭ জুলাই। এ দিন পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-যুবদলের সংঘর্ষ হয়। মহানগরের রেজিস্ট্রারি মাঠে গায়েবানা জানাযার নামাজ পড়তে দেয়নি পুলিশ। আন্দোলন দমাতে সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও সেটি প্রত্যখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। অপরদিকে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে সিলেটে বেশ কয়েক জন ছাত্রলীগ নেতা দল ছাড়েন।
রেজিস্টারি মাঠে গায়েবানা জানাযা পড়তে পারেনি বিএনপি :
কোটাবিরোধী আন্দোলনে ১৬ জুলাই ৬ শিক্ষার্থী নিহতের পর সিলেটে তাদের গায়েবানা জানাযার নামাজ পড়ার ঘোষণা দিয়েছিলো বিএনপি। ১৭ জুলাই বেলা আড়াইটার দিকে মহানগরের রেজিস্টারি মাঠে ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সমমনা দল’র ব্যানারে গায়েবানা জানাযার নামাজ আদায়ের প্রস্তুতি নিলে পুলিশ এসে বাঁধা দেয়।
এ সময় পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নেতাদের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে তারা সেখান থেকে সরে এসে কোর্ট মসজিদ প্রাঙ্গনে গায়েবানা নাজাযার নামাজ আদায় করেন।
এতে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী, সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন ও জেলা সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ।
বন্দরবাজারে সংঘর্ষ :
সিলেট মহানগরের বন্দরবাজার এলাকায় পুলিশ ও ছাত্রদল-যুবদল নেতাকর্মীদের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসময় ছাত্রদল-যুবদলের নেতাকর্মীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন। পরে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, ফাঁকা গুলি ও টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
সংঘর্ষে ৫ পুলিশসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে মহানগর ১৭ নং ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক আহবায়ক এম সাগর হাসান গুরুতর আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
১৭ জুলাই দুপুর পৌনে দুইটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। প্রায় ২০ মিনিট চলা সংঘর্ষের পর পুলিশের ধাওয়ায় ছাত্র ও যুবদল নেতাকর্মীরা ছত্রভ্ঙ্গ হয়ে যায়।
ওই দিন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর দেড়টার দিকে বন্দরবাজার এলাকার মহাজনপট্টি ও হকার্স মার্কেটের গলি থেকে ছাত্রদল-যুবদলের শতাধিক নেতাকর্মী কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে মিছিল বের করে। মিছিল নিয়ে কামরান চত্বরে এসে পুলিশ মোতায়েন দেখে তাদের দিকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন নেতাকর্মীরা। এসময় মহানগর পুলিশের টিম সিআরটি ঘটনাস্থলে এসে মিছিলকারীদের দিকে ফাঁকা গুলি, টিয়ার সেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। প্রায় ২০ মিনিট ব্যাপী সংঘর্ষে ৪ পুলিশ ও ৬ নেতাকর্মী আহত হন। একপর্যায়ে পুলিশ ধাওয়া দিয়ে মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তবে এসময় কাউকে আটক করা হয়নি।
শাবিতে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত, হল ছাড়েননি আন্দোলনকারীরা :
দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষে নিহতদের স্মরণে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ১৭ জুলাই।
ওই দিন বেলা দুইটায় ক্যাম্পাসে এই জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়।
এদিকে, আন্দোলনের কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন। একই সঙ্গে ১৭ জুলাই বিকেল তিনটার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে সেই নির্দেশ প্রতাখ্যান করেন শাবির আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে হলে খাবার সংকট হলে ক্যাাম্পাসেই খাবার তৈরি করবেন বলে জানান।
শাবি আন্দোলনকারীদের প্রধান সমন্বয়কারী আসাদুল্লাহ আল গালিব ওই দিন বলেন- আমরা ইউজিসি’র ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যা করে আন্দোলন চালিয়ে যাবো। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হল ত্যাগ করতে আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি করলে তাদেরকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করবো।
শাবির বিভিন্ন হলের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের তল্লাশি, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র জব্দ :
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ১৭ জুলাই সবাইকে হল ছাড়ার নির্দেশ দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরাণ হলের বিভিন্ন কক্ষে তল্লাশি চালান। এসময় হলটির কয়েকটি কক্ষ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, দেশিয় অস্ত্র ও মদের বোতল জব্দ করেন তারা। পরে বিকাল সাড়ে ৬টায় উদ্ধারকৃত অস্ত্র নিয়ে প্রেস ব্রিফিং করা হয়।
প্রেস ব্রিফিংয়ে আন্দোলনের শাবিপ্রবির সমন্বয়ক আসাদুল্লাহ আল গালিব বলেন- দেড় শতাধিক মদের বোতল, ১টি শর্টগান, ১টি রিভলবার, ৩টি চেইন, ১ শ স্টিলের পাইপ, ১০টি রামদা, ১২টি চাকু, হাতুড়ি ৩টা ও কিছু গাঁজা পেয়েছি। শুধু শাহপরাণ হলের বিভিন্ন কক্ষ থেকে এসব আমরা জব্দ করেছি। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার কারণে আর তল্লাশি চালাতে পারিনি। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) আমরা বাকি হলগুলোতে তল্লাশি করবো। আমরা জানতে পেরেছি- তল্লাশি শুরু হয়েছে জানতে পেরে সন্ত্রাসীরা অনেক অস্ত্র সরিয়ে ফেলেছে।
তিনি ওই দিন আরও বলেন- আজ থেকে শাবিকে ছাত্রলীগ ও সন্ত্রাসমুক্ত ঘোষণা করলাম। এরা এখানে মাদক কারবার করতো। আজ থেকে শাবিতে এসব বন্ধ। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি- আগামীতে যাতে রাজনৈতিক পরিচয়ে বা শক্তির জোরে হলের সিট বরাদ্দ দেওয়া না হয়, মেধা যাচাইয়ের ভিত্তিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যেন সিট দেওয়া হয়।
প্রেস ব্রিফিং শেষে মাদকদ্রব্য ও অস্ত্রগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসরেন কাছে হস্তান্তর করেন আন্দোলনকারীরা।
অন্যদিকে, ওই দিন বেলা দুইটার দিকে শাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি খলিলুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক সজীবুর রহমান হল ত্যাগ করেন।
শাবি ক্যাম্পাসে জাফর ইকবালকে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা :
১৭ জুলাই ড. জাফর ইকবালসহ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থানকারীদের ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা ও আজীবন নিষিদ্ধ করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক।
ওই সময় কোটাবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের স্লোগানের প্রেক্ষিতে নিজের একটি ওয়েবসাইটে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তাতে তিনি লিখেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়, আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়। তবে আমি মনে হয় আর কোনোদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাইব না। ছাত্রছাত্রীদের দেখলেই মনে হবে, এরাই হয়তো সেই রাজাকার। আর যে কদিন বেঁচে আছি, আমি কোনো রাজাকারের মুখ দেখতে চাই না। একটাই তো জীবন। সেই জীবনে আবার কেন নতুন করে রাজাকারদের দেখতে হবে?’
আন্দোলন নিয়ে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের এমন প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এরই ধারাবাহিকতায় শাবিতে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।