কওমি মাদরাসার ঐতিহাসিক ভূমিকা


মাওলানা কাসেম শরীফ

কওমি মাদরাসাগুলো স্থাপিত হয়েছে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দকে অনুসরণ করে। দেওবন্দ মাদরাসা কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—প্রতিষ্ঠানটির প্রথম সংবিধানে এর পাঁচটি উদ্দেশ্য লেখা হয়েছে—এক. কোরআন, হাদিস, আকিদা-বিশ্বাস ও এগুলোর সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা। মুসলমানদের পরিপূর্ণভাবে ইসলামের বিধি-নিষেধ জানানো। আর মানুষকে হেদায়েত ও আল্লাহর পথে আহ্বান করে ইসলামের সেবা করা।


দুই. ইসলামী শিষ্টাচার ও আমলের প্রশিক্ষণ দিয়ে ছাত্রদের মধ্যে ইসলামের প্রাণ সৃষ্টি করা। তিন. ইসলামের প্রচার-প্রসার, দ্বিনের হেফাজত ও লেখালেখির মাধ্যমে ইসলাম প্রচার, সর্বোপরি এর মাধ্যমে প্রথম যুগের মুসলমানদের চরিত্র, কর্ম ও ঈমানি প্রেরণায় এই যুগের মুসলমানদের জীবন ঢেলে সাজানো। চার. সরকার ও রাষ্ট্রের প্রভাবমুক্ত থাকা এবং (বিশেষত ধর্মীয় বিষয়ে) চিন্তার স্বাধীনতা স্থির রাখা। পাঁচ. ইসলামী শিক্ষা প্রসারে বিভিন্ন স্থানে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা এবং সেগুলো দারুল উলুম দেওবন্দের সঙ্গে সংযুক্ত করা।

(http://www.darululoom-deoband.com)
ওপরে উল্লিখিত কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পাঁচটি উদ্দেশ্যের আলোকে এ প্রশ্নের জবাব বের করা খুবই সহজ যে কওমি মাদরাসা জাতিকে কী দিয়েছে এবং কওমি মাদরাসাগুলো আসলে কী করতে চায়? তার পরও বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে এখানে দেওয়া হলো—এক. কওমি মাদরাসা কোরআন-হাদিস ও ইসলামী জীবনবোধের সঙ্গে সব শ্রেণি-পেশার মুসলমানদের জীবনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে চায়।

দুই. শহর থেকে গ্রামে প্রতিটি মসজিদে ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খতিবের ব্যবস্থা করেছে কওমি মাদরাসা।

তিন. মুসলমানদের যেকোনো ধর্মীয় প্রশ্নের সমাধান এবং পরিবর্তিত দুনিয়ার নিত্যনতুন যুগ-জিজ্ঞাসার মীমাংসার জন্য ফতোয়া বোর্ড ও ফতোয়া বিভাগ চালু করেছে কওমি মাদরাসা। কওমি মাদরাসা চায়, মুসলমানরা যেন সত্যিকার মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করতে পারে।


চার. অবক্ষয়, আগ্রাসন ও অপসংস্কৃতির ছোবলে বিধ্বস্ত সমাজ সংশোধনের লক্ষ্যে আধ্যাত্মিক পথনির্দেশক, সুফি-সাধক ও ধর্মীয় বক্তা তৈরি করে কওমি মাদরাসা।

পাঁচ. তাফসির, ফিকাহ, আকিদা, আমলসহ মুসলমানদের নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়ে পর্যাপ্ত বই মাতৃভাষায় রচনা ও অনুবাদ করেছে কওমি মাদরাসার আলেমরা। এতে একদিকে যেমন বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে, অন্যদিকে মুসলিম-অমুসলিম-নির্বিশেষে সবাই ইসলামকে জানার সুযোগ পেয়েছে।

ছয়. সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে কওমি মাদরাসা। তাই খ্রিস্টান মিশনারি ও এনজিওগুলোর অপতৎপরতা সম্পর্কে সবাইকে সজাগ করে তুলছেন এসব মাদরাসার আলেমরা।

সাত. অপরাধমুক্ত মানবতার বাসযোগ্য একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দেওয়ার ব্রতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে কওমি মাদরাসা। কওমি মাদরাসা থেকে যারা বের হয়, তারা গোটা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম অপরাধ করে থাকে। কওমি মাদরাসায় পড়া কেউ দুর্নীতি করে না। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়ায় না। মানুষ হত্যা করে না। ধর্ষণ করে না। লুণ্ঠন করে না। সুদ খায় না। ঘুষ নেয় না। দেশের টাকা আত্মসাৎ করে না। ইভ টিজিং করে না। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই করে না। বাংলাদেশের সামাজিক কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়ায় না কওমি মাদরাসার ছাত্ররা। সে হিসেবে কওমি মাদরাসার ছাত্ররা সত্যিকার অর্থে পুণ্যবান মানুষ। আর পুণ্যবান মানুষরাই দেশের সম্পদ, দেশের শ্রেষ্ঠ নাগরিক। দার্শনিক প্লেটো লিখেছেন : The good man must a good citizen....(George H. Sabine, History of political Theory. New York : 1950. p. 41) অর্থাৎ একজন পুণ্যবান ব্যক্তি অবশ্যই একজন আদর্শ নাগরিক। সুতরাং কওমি মাদরাসা শুধু ধর্মীয় বিদ্যাপীঠই নয়, আদর্শ নাগরিক গড়ার কেন্দ্র।

আট. মুসলমানদের আকিদা-বিশ্বাসবিরোধী যেকোনো আইন, উদ্যোগ ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক জীবন দিয়ে হলেও রুখে দাঁড়ায়। শত উন্মাদ কলরবে ধর্মের জয়গান গেয়ে যায়। মানুষের ধর্ম পালনের অধিকার আদায়ে অবিরত সংগ্রাম করে যাচ্ছে কওমি মাদরাসা।

নয়. দেশের প্রতিটি জনপদে, শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে হাজারো মসজিদ-মাদরাসা স্থাপন করে মুসলমানদের জন্য ঈমানি দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেছে কওমি মাদরাসা। এসব মসজিদ-মাদরাসায় এমন লাখো পরিবারের সন্তানদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সরকারি শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা যাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এ অর্থে রাষ্ট্রের অপূরণীয় শূন্যতা পূরণ করছে কওমি মাদরাসা।

বাংলাদেশে বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ১১ থেকে ১৫ লাখ অনাথ শিশু আছে। দেশে কর্মরত এনজিওগুলোর হিসাব মতে, এ সংখ্যা ৫৫ লাখের মতো। (সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২১ এপ্রিল, ২০১৬) বলা বাহুল্য, দেশের প্রতিটি কওমি মাদরাসা (ছোট, মাঝারি ও বড়) এতিমখানাযুক্ত। দেশের মোট কওমি মাদরাসার সংখ্যা ২২ হাজারের মতো। বিভিন্ন মাদরাসার সংগৃহীত খবর মতে, গড়ে প্রতিটি মাদরাসায় অসহায় শিশুর সংখ্যা ৪০-৫০ জন। তাহলে আপাতত ৫০ জনকে ধর্তব্য মনে করে যদি হিসাব করা যায়, তাহলে তাদের সংখ্যা সর্বমোট ১১ লাখ। বলা যায়, এনজিওগুলোর হিসাব মতে, ৫৫ লাখ অসহায় শিশুর মধ্যে দেশের ২২ হাজার কওমি-মাদরাসা ১১ লাখ অসহায় শিশুর শিক্ষা ও ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করছে!

দশ. মধ্যপ্রাচ্যে বিপুলসংখ্যক শ্রমশক্তির জোগান দিচ্ছে কওমি মাদরাসা। কওমি আলেমসমাজের একটি অংশ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মসজিদে ইমাম-মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁরা সার্বক্ষণিকভাবে আরবসমাজে দেশ ও জাতি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরিতে সচেষ্ট।

এগারো. কওমি মাদরাসা ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ তথা সরল-সঠিক পথের অতন্দ্র প্রহরী, যা রাসুল (সা.) থেকে সাহাবায়ে কেরাম, সাহাবায়ে কেরাম থেকে তাবেঈন, তাবেঈন থেকে তাবে তাবেঈন ও আইম্মায়ে মুজতাহিদিন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে পৌঁছেছে। অতঃপর আইম্মায়ে মুজতাহিদিন থেকে প্রতি যুগেই এ আমানত উম্মতের নির্বাচিত মনীষীদের মাধ্যমে পৌঁছেছে। নিঃসন্দেহে তা সামষ্টিকভাবে অক্ষত। হেদায়েতের এমন কোনো পথ নেই, যাতে কওমি আলেম দ্বারা পথনির্দেশিকা স্থাপন করা হয়নি। বিশ্ব পরিস্থিতিতে দ্বিনের অপব্যাখ্যা ও অপপ্রচার সম্পর্কে মুসলিম জাতিকে সচেতন করে তোলেন কওমি উলামায়ে কেরাম। তাঁরা ইসলাম ও মুসলিম জাতির হেফাজতের দায়িত্ব পালন করছেন। দারুল উলুম দেওবন্দের কৃতী সন্তান মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) প্রতিষ্ঠিত তাবলিগ জামাত বিশ্বব্যাপী দ্বিন প্রচারে কাজ করে যাচ্ছে। কওমি ওলামায়ে কেরাম হাদিস, ফিকাহ, তাফসিরসহ বিভিন্ন শাস্ত্রের সহায়ক বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। পাশাপাশি কোরআনের অপব্যাখ্যা, বিকৃত ব্যাখ্যাকারীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে মুসলিম উম্মাহকে এ বিষয়ে সচেতন করেন।

কওমি মাদরাসা যত প্রত্যন্ত অঞ্চলেই অবস্থিত হোক না কেন, যত জীর্ণ, শীর্ণ ও সাদাসিধা হোক না কেন, মুসলিমসমাজে এসব মাদরাসার প্রভাব দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এসব মাদরাসার বদৌলতে এখনো পৃথিবীতে কালেমার ধ্বনি শোনা যায়। ঈমানের ডাকে অদৃশ্যের আহ্বানে মানুষ সাড়া দেয়। এ মাদরাসাগুলোর কারণেই এখনো পৃথিবীতে আল্লাহর আওয়াজ সমুন্নত আছে। দ্বিন-ধর্মকে তার প্রকৃত রূপ, অবয়ব ও কাঠামোতে সংরক্ষিত রাখার ঐতিহাসিক দায়িত্ব কওমি মাদরাসা পালন করে আসছে।