হাসিনার ‘সম্পর্কিত’ লোককে শাবিতে নিয়োগ দিতে ভিসি ফরিদের সুপারিশ

কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ও খনি প্রকৌশল (পিএমই) বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে সাবেক উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন হস্তক্ষেপ করেছিলেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সাবেক উপাচার্যের ‘সুপারিশে’ নিয়োগ পাওয়া এক প্রভাষককে গত ৪ আগস্ট কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন।

মো. তাজবিউল ইসলাম নামের ওই প্রভাষক আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতার শর্তাবলি পূরণ না করা সত্ত্বেও আবেদন করেছিলেন বলে নোটিশে অভিযোগ করা হয়েছে। এ কারণে কেন তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হবে না তা অনতিবিলম্বে জবাব দেওয়ার জন্য বলেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কারণ দর্শানোর নোটিশে আরও বলা হয়েছে, ‘আপনার নিয়োগের ব্যাপারে তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ কর্তৃক বোর্ডের সদস্যদের ওপর সরাসরি প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। তিনি এসএমএসের মাধ্যমে বোর্ড সদস্যদের প্রভাবিত করেছেন এবং যোগ্য একজন প্রার্থীকে বাদ দিয়ে আপনাকে নিয়োগের চাপ প্রয়োগ করেছেন, যা তদন্ত রিপোর্টে প্রমাণসহ উল্লেখ করা হয়েছে।’

অভিযোগের বিষয়ে প্রভাষক তাজবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমি অনলাইনে একটি বিজ্ঞপ্তি পেয়ে চাকরির আবেদন করেছিলাম। তখন আমাকে পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। ওই সময় কর্তৃপক্ষ আমাকে নিয়োগ দেওয়াতে আমি জয়েন করি। এখন আমার যোগ্যতা আছে কি-নাই, সেটা যাছাই-বাছাই করার দায়িত্ব ছিল কর্তৃপক্ষের।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ দায়িত্বে থাকাকালীন পেট্রোলিয়াম ও খনি প্রকৌশল (পিএমই) বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ পান মো. তাজবিউল ইসলাম। গত বছরের ১০ জুন তিনি বিভাগে যোগদান করেন। নিয়োগের শর্ত পূরণ না করায় সেই সময় বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। গত বছরের ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ায় পিএমই বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রভাষক তাজবিউলের নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৩ অক্টোবর তদন্ত কমিটি করে প্রশাসন। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাজবিউলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ওই প্রভাষক নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ছিলেন সাবেক সহ-উপাচার্য মো. কবির হোসেন। ওই বোর্ডের সদস্য ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন মোহাম্মদ রেজা সেলিম ও পিএমই বিভাগের তৎকালীন প্রধান এম ফরহাদ হাওলাদার। ওই দিনের বোর্ডে অনলাইনে আরও যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম।

তদন্ত প্রতিবেদন ও কমিটির সদস্যদের সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে বাছাইয়ের আগে বোর্ডের সদস্য মোহাম্মদ রেজা সেলিমের কাছে হোয়াটসঅ্যাপে ইংরেজিতে একটি বার্তা পাঠান সাবেক উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। যা বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘প্রিয় ডিন, সুস্মিতা সরকার (অন্য এক প্রার্থী) ২০২২ সালে ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। আমি আইআইটি শিবপুর থেকে পাস করা মো. তাজবিউল ইসলামকে নিতে অনুরোধ করব। তাঁর সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক রয়েছে।’

একই দিনে একই ব্যক্তির কাছে বাংলায় পাঠানো আরেকটি বার্তায় ফরিদ উদ্দিন লিখেন, ‘সুস্মিতা আন্দোলনে জড়িত ছিল। ওপরের ছবিগুলো তার প্রমাণ। তাকে না নিয়ে নিচের প্রার্থীকে নিলে ভালো হয়।’ বার্তার নিচে তাজবিউলের তথ্য পাঠান সাবেক উপাচার্য। একই বার্তা বোর্ডের আরেক সদস্য এম ফরহাদ হাওলাদারের কাছেও পাঠান তিনি।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, তাজবিউলের নিয়োগের শর্ত পূরণ না হওয়ায় সিন্ডিকেট সভার আগেই তৎকালীন উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার করার কথা বলেন মোহাম্মদ রেজা সেলিম ও এম ফরহাদ হাওলাদার। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নেয়নি।

একই সঙ্গে তাজবিউলের স্নাতক ডিগ্রির গ্রেড ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের হওয়ায় বাংলাদেশের গ্রেডিং পদ্ধতিতে রূপান্তর করলে তা নিয়োগে শর্ত পূরণ করেনি। কিন্তু নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও তৎকালীন সহ-উপাচার্য মো. কবির হোসেন বাংলাদেশের গ্রেডিং পদ্ধতিতে রূপান্তর করার প্রয়োজনীয়তা মনে করেননি। বরং তার নেতৃত্বে বোর্ড তাজবিউলকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছিল।

উপাচার্যের চাপ প্রয়োগের কথা স্বীকার করেছেন মোহাম্মদ রেজা সেলিম ও  এম ফরহাদ হাওলাদার। এম ফরহাদ হাওলাদার বলেন, ‘উপাচার্য মেসেজ দিয়েছিলেন। শুধু আমাকে নয়, বোর্ডের সব সদস্যকেই দিয়েছিলেন। বিভাগের মঙ্গলের স্বার্থে উপাচার্যের কথা তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।’ তা না হলে পরবর্তী সময়ে এর ঘানি টানতে হবে- এ আশঙ্কা তিনি করছিলেন।

এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক আবুল মুকিত মোহাম্মদ মোকাদ্দেছ বলেন, ‘নিয়োগ বোর্ডের সদস্যদের সাবেক উপাচার্য ফরিদ আহমেদ কর্তৃক চাপ প্রয়োগের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। এমন তথ্য–প্রমাণাদি আমরা পেয়েছি। নিয়োগ বোর্ডের সদস্য না হয়ে তিনি একজন উপাচার্য হিসেবে তা করতে পারেন না।’

তবে সাবেক উপাচার্যের সুপারিশের অভিযোগের বিষয়ে প্রভাষক তাজবিউল ইসলাম বলেন, ‘সাবেক উপাচার্যের সঙ্গে আমার কোনো দিন কথাই হয়নি। কেন তিনি আমার জন্য সুপারিশ করেছেন তা আমার জানা নেই। এ ছাড়া তিনি কেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রেফারেন্স দিলেন, তা–ও জানি না। কারণ, তাঁর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্কই নেই।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে একাধিকবার কল দিলে তাঁর নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। গত দুই দিনে হোয়াটঅ্যাপসহ বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

অভিযোগের বিষয়ে সাবেক সহ-উপাচার্য মো. কবির হোসেন বলেন, ‘নিয়োগ বোর্ডের যাচাই–বাছাই করার বিষয়টি আমাকে দেওয়া হতো না (নিয়মানুযায়ী এর দায়িত্ব সহ-উপাচার্যের)। আমাকে শুধু বলা হতো নিয়োগ বোর্ডের তারিখ ঘোষণার জন্য। আমি লিখে দিলে উপাচার্য অ্যাপ্রুভ করতেন। তাজবিউলের বিষয়টি তাঁর কাগজপত্র যা এসেছিল তা শুধু দেখেছিলাম এবং নিয়োগ বোর্ডের এক্সপার্টদের সুপারিশের ভিত্তিতে ফাইল পাঠিয়েছিলাম। তবে ওই প্রভাষকের নিয়োগের বিষয়ে আমাকে কেউ চাপ প্রয়োগ করেনি।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কালাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত কমিটির সুপারিশ এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রভাষক তাজবিউল ইসলামকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তাঁর পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা এলে তা সিন্ডিকেটে উপস্থাপন করা হবে। সিন্ডিকেটে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

(মূল রিপোর্ট : প্রথম আলো)