ইসলামী বিষয়ে মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে যা করণীয়

মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ

মহান আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের প্রধান উৎস ওহি। মহান আল্লাহর আদেশ ও প্রিয় নবী (সা.)-এর আদর্শভিত্তিক শিক্ষা ‘ইলম’ বা ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করা ফরজ। জ্ঞানের সুবিশাল ভাণ্ডারের তাৎপর্য অনুধাবন করা যায় মহান আল্লাহর বাণীতে : ‘...আর জ্ঞানের অতি সামান্যই তোমাদের দেওয়া হয়েছে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৮৫)

ওহির জ্ঞানে জ্ঞানী ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতজনের যোগ্যতা ও জ্ঞানার্জনের পথ-পদ্ধতি অভিন্ন নয়।


তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় বা ব্যক্তিগত পড়াশোনায় যেকোনো বিষয়ে সামান্য ধারণা পাওয়া গেলেও ওই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া ও অভিমত দেওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হয় না। আইন-সংবিধান, শিল্প-সাহিত্যের সম্ভার, মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা কোনো শাস্ত্রের গ্রন্থ কারো শোকেস ভরা থাকলেই কেউ ওই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হয় না, বরং তাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আগ্রহী বলা যায় মাত্র। ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হলে মানসম্পন্ন মাদরাসা অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সর্বোচ্চ সনদপ্রাপ্ত হওয়ার বিকল্প নেই। কেননা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া কোনো বিদ্যার স্বীকৃতি নেই।

সমাজে ইদানীং তথাকথিত স্বশিক্ষিত, সাধারণ শিক্ষা, অপশিক্ষা, অর্ধশিক্ষায় শিক্ষিতজনরা ধর্মীয় বিষয়ে মতামত দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। সাধারণ শিক্ষিতদের ধর্মীয় বিষয়ে অভিমত সম্পর্কে সতর্ক করে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘...যখন একজন সত্যপন্থী আলেমও থাকবে না, তখন লোকেরা মূর্খদের তাদের নেতা হিসেবে গ্রহণ করবে। এই মূর্খরা ধর্মীয় বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হলে অজ্ঞতা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত দেবে। ফলে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে, অন্যদেরও পথভ্রষ্ট করবে।’ (বুখারি)

প্রিয় নবী (সা.) আরো বলেন, ‘কিয়ামতের আলামতের মধ্য একটি হলো ইলম উঠিয়ে নেওয়া এবং মূর্খতা বৃদ্ধি পাওয়া...।’ (বুখারি)

ইসলামের সূচনায়ই বলা হলো—‘পাঠ করো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।...তিনি মানুষকে তা-ই শিখিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ১-৫)

পবিত্র কোরআনের অনুবাদ, ব্যাখ্যার ন্যূনতম মূলনীতি :

১। ইলমুল লুগাহ বা ভাষাজ্ঞান

২। ইলমুস সরফ বা আরবি শব্দ প্রকরণ সম্পর্কীয় জ্ঞান

৩। ইলমুন নাহু বা আরবি বাক্য প্রকরণ সম্পর্কীয় জ্ঞান

৪। ইলমুল ইশতিকাক বা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত জ্ঞান

৫। ইলমুল মাআনি বা শাব্দিক অলংকরণ

৬। ইলমুল বয়ান বা বাক্য প্রয়োগগত অলংকরণ

৭। ইলমুল বদি বা ছন্দ প্রয়োগে অলংকরণ

৮। ইলমুল কিরাআত বা আল-কোরআন পঠনরীতির জ্ঞান

৯। উসুলুদ্দিন বা ধর্মের মৌলিক ভিত্তি ও মূলনীতির জ্ঞান

১০। উসুলুল ফিকহ বা ফিকহের মূলনীতির জ্ঞান

১১। আসবাবুন নুজুল ওয়াল কাসাস বা সুরা ও আয়াতসমূহ নাজিল হওয়ার কাল-প্রেক্ষিত, কারণ ও ঘটনাবলি সম্পর্কিত জ্ঞান

১২। আন নাসিখ ওয়া মানসুখ বা রহিতকারী আয়াত ও রহিত আয়াত সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান

১৩। ইলমুল ফিকহ বা আইন বিষয়ক জ্ঞান

১৪। উলুমুল হাদিস বা হাদিসের উৎসগত জ্ঞান

১৫। ইলমুল মাওহাবাহ বা আল্লাহ প্রদত্ত সরাসরি জ্ঞান, যার অপর নাম ইলমুল লাদুন্নি

১৬। আল্লাহর জাত, সিফাত, হুকুম ও ইখতিয়ার সম্পর্কে বা মহান আল্লাহর সত্তা, গুণাবলি, হুকুম-আহকাম ও ক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান

১৭। ইলমুল মাকান ওয়া জামান বা কোরআন নাজিলের স্থান-কাল সম্পর্কে জ্ঞান

১৮। উলুমুল কোরআন তথা কোরআন বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের শাখা সম্পর্কে জানা

১৯। ইলমুত তাওয়ারিখ বা ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান।

এ বিষয়গুলোর পাশাপাশি হাদিস, ফিকহশাস্ত্রের মানদণ্ডে যথার্থ জ্ঞান ছাড়া কেউ ধর্মীয় বিষয়ে বলতে ও লিখতে পারেন না।

বস্তুত ধর্মীয় জ্ঞান ও সাধারণ শিক্ষা পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং উভয়ের পার্থক্যই সুস্পষ্ট। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে?’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৯)

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘উত্তম ব্যক্তি হলো ওই ব্যক্তি, যে ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ। যদি তার কাছে লোকজন মুখাপেক্ষী হয়ে আসে, তাহলে সে তাদের উপকার সাধন করে...।’ (মিশকাত শরিফ)

তাই ধর্মীয় বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরাই শুধু ধর্মীয় বিষয়ে মতামত দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শুধু তাঁদের কথাই গ্রহণযোগ্য হবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান- ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর