তাওহীদ আদনান ইয়াকুব >>
ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসরের ঐতিহাসিক একটি শহর সারহিন্দ, যার স্তরে স্তরে জড়িয়ে আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। শহরটি যেন এক বিশাল খোলা বই, যেখানে প্রতিটি পাতায় বোনা আছে অতীতের গল্প, ইতিহাসের ছাপ এবং আধ্যাত্মিকতার অনুধাবন।
এই শহরেই অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম- বারাস। খোলা চোখে এটি স্রেফ একটি সাধারণ গ্রাম, কিন্তু এর অন্তরালে লুকিয়ে আছে এক অজানা রহস্য। এখানে শায়িত আছেন বহু নবী-রাসুল ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব; যা যুগ থেকে যুগান্তরে মানুষের অন্তরে জাগিয়ে রেখেছে এ জায়গার প্রতি আধ্যাত্মিক টান ও অনুপ্রেরণা। বারাস শুধু একটি গ্রাম নয়, ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতার এক অবিচ্ছেদ্য মিলনমেলা।
শহর পেরিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে বারাসে পৌঁছালে দেখা মেলে একটি সুদর্শন গেট, যার শীর্ষে লেখা রয়েছে, ‘কুবুরে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম।’ যেন আগন্তুককে স্বাগত জানায় অতীতের এক অদৃশ্য জগৎ। সরু ধুলোমাখা পথ বেয়ে টিলায় উঠতে গেলে মনে হয়, আগন্তুক যেন এগিয়ে যাচ্ছেন ভিন্ন কোনো জগতের দিকে, হৃদয়ে জেগে ওঠে এক ভিন্ন শিহরণ।
টিলার চূড়ায় গেলেই নজরে পড়ে লম্বা লম্বা নয়টি কবর। একদিকে প্রথম সারিতে চারটি, তারপর আরেক দিকে দুটি পাশাপাশি, খানিকটা দূরে আরও দুটি, এরপর এক কোণে একাকী একটি। অধিকাংশ কবরই প্রায় সাত গজ দীর্ঘ; যা দেখলেই মনে হয়, কবরগুলো কোনো সাধারণ মানুষের নয়। পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া-দরুদ পাঠ করলে মনে হয় চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে আসছে; নীরবতা যেন আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। পাশেই রয়েছে ছোট্ট মাদ্রাসা, একটি হিফজখানা ও সুদর্শন মসজিদ। সারাক্ষণ শিশুদের মিষ্টি কণ্ঠে কোরআন তিলাওয়াতের ধ্বনি ভেসে আসে, যা শুনে মনে হয়—হাজার বছরের ইতিহাস আজও জীবন্ত।
ইসলামি ঐতিহ্য অনুসারে দুনিয়াতে ১ লাখ ২৪ হাজার কিংবা ২ লাখ ২৪ হাজার নবী-রাসুল এসেছিলেন মানবজাতিকে দিশা দেখাতে। কোরআনে উল্লেখ আছে তাঁদের মধ্যে মাত্র ২৫ জনের নাম। কিন্তু কোরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রতিটি জাতির জন্য রয়েছে পথপ্রদর্শক।’ (সুরা রাদ: ৭)
এ ঘোষণার আলোকে ইতিহাসবিদ ও আধ্যাত্মিক সাধকেরা একমত; এই ভারত উপমহাদেশও নবুয়তের আলো থেকে বঞ্চিত হয়নি। সেই আলোকরশ্মির এক অমোঘ স্মারক হলো বারাসে অবস্থিত নবীদের কবর। ধারণা করা হয়, নুহ (আ.)-এর সময়কার কিছু নবী-রাসুল আল্লাহর নির্দেশে তাঁদের অনুসারীদের নিয়ে ভারতবর্ষে হিজরত করেছিলেন। তাঁরা এখানে এসে বসবাস শুরু করেন এবং মানুষকে একত্ববাদ ও ন্যায়ের বাণী শোনান। ইন্তেকালের পর তাঁরা এখানেই সমাহিত হন।
সময়ের পরিক্রমায় নানা প্রতিকূলতায় একসময় মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায় নবীদের এই স্মৃতিচিহ্নের কথা। এরপর শায়েখ আহমাদ সারহিন্দি (রহ.); যিনি মুজাদ্দিদে আলফে সানি নামে পরিচিত, কাশফের মাধ্যমে জানতে পারেন, বারাসে শায়িত আছেন বহু নবী ও রাসুল। তিনি কবরগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। কাশফের মাধ্যমে প্রাপ্ত ইশারায় ৯টি কবর চিহ্নিত করতে সক্ষম হন তিনি। আজও তাঁর চিহ্নিত সেই কবরগুলো রয়েছে পূর্ণ অক্ষত।
জানা যায়, হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রহ.) এবং দারুল উলুম দেওবন্দের তৎকালীন শায়খুল হাদিস হজরত জাকারিয়া (রহ.)-এর মতো গবেষকেরাও এখানে জিয়ারত করেছেন। দারুল উলুম দেওবন্দের বর্তমান প্রধান মুফতি আল্লামা হাবিবুর রহমান খায়রাবাদি এর যথার্থতা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে গেলে হৃদয়ে প্রশান্তি মেলে’। স্থানীয় প্রবীণেরা বলেন, ‘এই স্থান নবীদের কবর বলে আল্লাহর মারফতে সংরক্ষিত। এখানে বিদআত নেই, অপসংস্কৃতি নেই। আছে শুধু আধ্যাত্মিক প্রশান্তি।’
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া শরীয়তপুর।
.png) 
                     
                     
                     
                         
                                                 
                                                 
                                                 
                                                 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    