জীবনের মূল্য পাঁচ লক্ষ টাকা!

মো. রুহুল আমিন >>

জীবনের দাম কত? এই প্রশ্নটা যেন এখন আর কেবল দার্শনিক নয়—আমাদের দেশে এটি এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের ফার্মগেট এলাকায় ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আবারও এই প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছে।

ছয় বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট, দুই সন্তানের জনক আবুল কালাম আজাদ কাজের প্রয়োজনে ফার্মগেট এলাকায় যান। কিন্তু ভাগ্য ছিল নির্মম। মেট্রোরেলের পিলারের একটি বিয়ারিং প্যাড পড়ে মুহূর্তেই থেমে যায় তার জীবন। পরের দিন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে — নিহতের পরিবারকে দেওয়া হবে পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ!

এই ঘোষণাটি যেন আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে নগ্ন সত্যটিই প্রকাশ করে দিল: এই দেশে একটি মানুষের জীবনের মূল্য মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকা!

অন্যায়ের সংস্কৃতি ও মৃত্যুর সহজলভ্যতা:
বাংলাদেশে দূর্ঘটনা জনিত মৃত্যু এখন আর বিস্ময়ের কিছু নয়। এটি যেন এক অলিখিত সামাজিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে — যেখানে অবহেলা, অনিয়ম, দুর্নীতি আর দায়হীনতা মিলেমিশে তৈরি করেছে এক ভয়ানক বাস্তবতা।

সড়কে, কর্মক্ষেত্রে, হাসপাতালে, এমনকি ঘরে-বাইরেও — মৃত্যুর কারণগুলো প্রায় একই: অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতার অভাব।
কোনো প্রকল্পের ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণ, অরক্ষিত বিদ্যুৎ লাইন, অনিয়মিত তদারকি — সবকিছুর মাশুল দিতে হয় সেই সাধারণ মানুষকেই, যার জীবন রাষ্ট্রের কাছে নিতান্ত তুচ্ছ!

আজাদদের মৃত্যু তাই কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়; এটি এক সমাজব্যবস্থার প্রতীকী পতন, যেখানে “অন্যায়ের দায়” হারিয়ে যায় ক্ষমতার ছায়ায়।

ক্ষমতার লোভ ও দুর্নীতির অঙ্ক:
উন্নয়নের জোয়ারে দেশ এগোচ্ছে—এমন স্লোগান আমরা প্রতিদিন শুনি/ শুনতাম। কিন্তু এই উন্নয়নের ভিতটা দাঁড়িয়ে আছে দুর্নীতির কংক্রিটে।

একটি প্রকল্পে হাজার কোটি টাকার বাজেট থাকে, কিন্তু সেখানে গুণগত মান নিশ্চিত করার গরজ থাকে না। ঠিকাদার, তদারকি কর্মকর্তা, প্রকল্প পরিচালক—সবাই নিজের ভাগ তুলে নেয়, আর নির্মাণ হয় নিম্নমানের, প্রাণঘাতী অবকাঠামো।

ফলাফল? কোনো এক আজাদ, কোনো এক শ্রমিক — প্রাণ হারায়। তাদের মৃত্যু হয় ‘অবহেলা’ নামে, আর দায়ীদের পুরস্কার হয় নীরবতা।

এভাবেই ক্ষমতার লোভ আর দুর্নীতির হিসাব চুকিয়ে দেয় সাধারণ মানুষ নিজের জীবন দিয়ে।

বাঁচার কিংবা মরার মূল্য: এক কঠিন বাস্তবতা। এই দেশে সাধারণ মানুষের জীবন এক অদ্ভুত সমীকরণে বাঁধা পড়ে গেছে। চিকিৎসা পেতে হলে দিতে হয় টাকা, নইলে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু অনিবার্য।

কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা; চাইলে দরকার প্রভাবশালীর ছায়া, নইলে দুর্ঘটনা অনিবার্য। আইনি প্রতিকার চাইলে ঘুষ ছাড়া ন্যায় অধরাই থেকে যায়।

এ যেন এক রাষ্ট্রীয় প্রহসন—যেখানে বাঁচতেও মূল্য দিতে হয়, মরতেও হিসাব মেলাতে হয় টাকায়!

আর শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র বা কর্তৃপক্ষের চোখে এই পাঁচ লক্ষ টাকাই হয়ে ওঠে একমাত্র সমাধান।

একটি জীবনের বিনিময়ে,দুই সন্তানের পিতার মৃত্যুর বিনিময়ে—পাঁচ লক্ষ টাকা! যেন একজন মানুষ নয়, বিক্রি হয়েছে কেবল একটি নামহীন সংখ্যা।

রাষ্ট্রের দায় ও সমাজের নীরবতা:
একটি সভ্য রাষ্ট্রে নাগরিকের জীবনই সর্বোচ্চ মূল্যবান সম্পদ। কিন্তু আমাদের দেশে রাষ্ট্র যেন ক্রমেই হয়ে উঠছে এক দায়হীন দর্শক, যে শুধু দুর্ঘটনার পর ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে নিজের দায় সারতে চায়।

আর আমরা, সমাজ হিসেবে তাতেই যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ মিইয়ে গেছে, মানবতার জায়গা দখল করেছে উদাসীনতা।

এই নীরবতাই সবচেয়ে ভয়ংকর—কারণ এতে জন্ম নেয় নতুন অন্যায়, নতুন আজাদদের মৃত্যু।

শেষ কথা: আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে অন্যায় করে যে বেঁচে যায়, আর অন্যায় ভোগ করে যে মরে—রাষ্ট্রের চোখে দুজনেরই মূল্য প্রায় সমান।

যতদিন এই দেশে মানুষ তার ন্যায্য অধিকার, নিরাপত্তা এবং মর্যাদা ফিরে না পাবে, যতদিন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের শৃঙ্খল না ভাঙবে, ততদিন সাধারণ মানুষের জীবন এভাবেই সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে বিক্রি হতে থাকবে।

এই পাঁচ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ কোনো সহায়তা নয়—এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতীক, আমাদের মানবিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন।

একটি প্রাণের মূল্য কখনো টাকায় মাপা যায় না,
যদি মাপতেই হয়—তবে সেই মূল্য হবে আমাদের বিবেকের মৃত্যু।

লেখক: মো. রুহুল আমিন
শিক্ষক, সামাজিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।