কওমি কণ্ঠ রিপোর্টার :
গত ১৫ বছরে স্কুল-কলেজভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার- শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষকদের এমনটাই বক্তব্য। তাই সাধারণ শিক্ষা নিয়ে বেশিরভাগ মানুুষ হতাশ। এটিসহ বিভিন্ন কারণে দেশের কওমি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে মানুষের, এর প্রতি ঝুঁকছেন সব শ্রেণির লোকজন। নিজেদের সন্তানকে সুশিক্ষিত করতে ভর্তি করছেন কওমি মাদরাসায়।
এছাড়া সাধারণ শিক্ষার প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্তানকে পড়াতে লাগে কাড়ি কাড়ি টাকা। কিন্তু কওমি শিক্ষাব্যবস্থায় সে তুলনায় খুবই সামান্য টাকায়, কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিনাখরচে সন্তানকে পড়াতে পারছেন অভিভাবকরা। ফলে এ কারণেও বিগত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অভিভাবক সন্তানদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কওমি মাদরাসাকেই বেছে নিয়েছেন।
দেশে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা দুই ধারার- কওমি ও আলিয়া। এর মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসাগুলো সাধারণত সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। তাদের শিক্ষাক্রমে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সরকারি কারিকুলাম অন্তর্ভুক্ত থাকে। সেই সঙ্গে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্যও সংরক্ষণ করে বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)।
অপরদিকে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা পরিচালিত হয় সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে এবং শিক্ষাক্রমও পুরোপুরি নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি। এমনকি এ ধারার প্রতিষ্ঠানগুলোয় কোনো মনিটরিং কিংবা অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সুস্পষ্ট পরিসংখ্যান সরকারের কাছে নেই।
দেশে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম বর্তমানে ছয়টি বৃহৎসহ অল্প কিছু ছোট বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বোর্ড ধরা হয় বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক)।
এটির অধীনে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত তিন বছরে পরীক্ষার্থী বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। বেফাকের ২০২২ সালের পরীক্ষায় মোট ২ লাখ ২৫ হাজার ৬৩১ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। সেখানে চলতি বছর ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭৬ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসে। সে হিসাবে তিন বছরের ব্যবধানে পরীক্ষার্থী বেড়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৪১৫ জন। এর মধ্যে মেয়ে পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
বেফাকের এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে এ বোর্ডের অধীনে সারা দেশে প্রায় ২৯ হাজার মাদ্রাসা রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ১৭ হাজার ৩৬২টি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবার কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।
সাধারণ শিক্ষায় যদিও এর ঠিক উল্টো চিত্র, প্রতিনিয়তই কমছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। অষ্টম শ্রেণীর গণ্ডি শেষ করে ২০২২ সালে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করে ২২ লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৩ শিক্ষার্থী। আর সে ব্যাচের শিক্ষার্থীরা গত বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষায় (এসএসসি) বসে। অথচ এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বসেছিল ১৭ লাখ ১০ হাজার ২৯৬ জন। সে হিসাবে মাধ্যমিক পর্যায়ে ওই দুই বছরে ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩৭ জন ঝরে পড়ে, যা মোট শিক্ষার্থীর ২৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। শিক্ষার্থী কমছে প্রাথমিক পর্যায়েও। প্রাথমিক শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ও কিন্ডারগার্টেনে বাড়লেও ২০২২ সালের তুলনায় ওই বছর কেবল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই কমে ১০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী।
শিক্ষাবিদরা বলছেন- মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার দিন দিনই বাড়ছে। আবার অনেক শিক্ষার্থী চলে যাচ্ছে কওমি মাদ্রাসায়। ধর্মীয় চিন্তার পাশাপাশি করোনা-পরবর্তী সময়ে দরিদ্রতা কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বাড়ার অন্যতম কারণ। দেশে এখন সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা কওমি।
কওমি মূলত ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ মাদ্রাসার আলোকে প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা। এখানে কোরআন-হাদিসের মূল ধারার শিক্ষার উপর বেশি জোর দেয়া হয়। আর কওমি ধারায় সর্বোচ্চ পরীক্ষা ‘দাওরায়ে হাদিস’।
আওয়ামী লীগ সরকার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমতুল্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া, বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙ্গা, আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম, তানযীমুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মদারিস ও বেফাকুল মাদারিসিদ্দীনিয়্যা বাংলাদেশ- এ ছয়টি বোর্ড নিয়ে আল-হাইআতুল উলইয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ নামে একটি বোর্ড গঠন করা হয়। দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষা এ বোর্ডের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়। ২০২২ সালের এ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ২৪ হাজার ৯২৯ শিক্ষার্থী। আর চলতি বছর অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় ৩২ হাজার ৭১৮ শিক্ষার্থী অংশ নেন। সে হিসাবে এ স্তরে পরীক্ষার্থী বেড়েছে প্রায় ৩১ দশমিক ২৪ শতাংশ।
কওমি সনদের স্বীকৃতি আদায়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। অরাজনৈতিক বৃহৎ এ সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতির মূল উদ্দেশ্য ছিল, এ শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্র বা সরকার যেন শিক্ষিত হিসেবে গণ্য করে। একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্ব ও কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য যে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হয়, এ স্বীকৃতির মাধ্যমে তা অর্জিত হয়েছে। তবে এ স্বীকৃতিকে অধিকতর কাজে লাগানোর জন্য আরো কয়েকটি লক্ষ্য রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো এ শিক্ষা সনদের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কওমি গ্র্যাজুয়েটদের ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি। তবে সে লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি। আরেকটি লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ স্বীকৃতি সহায়ক ভূমিকা রাখা। কিন্তু সেক্ষেত্রে এটি কাজে লাগছে না।’
ব্যানবেইস সর্বশেষ ২০১৫ সালে কওমি মাদ্রাসায় একটি জরিপ পরিচালনা করে। তাতে মোট ১৩ হাজার ৯০২টি মাদ্রাসা এবং মোট ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ২৫২ শিক্ষার্থীর তথ্য উঠে আসে। যদিও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই জরিপে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক মাদ্রাসার তথ্যই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাছাড়া প্রতি বছরই বাড়ছে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের পাশাপাশি অন্য বোর্ডগুলোর অধীন মাদ্রাসায়ও শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বোর্ড-সংশ্লিষ্টরা। সিলেট অঞ্চলের একটি বোর্ড আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তালিম বাংলাদেশ।
এ বোর্ডের মহাসচিব মাওলানা আবদুল বছির জানান, প্রতি বছর প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে আমাদের বোর্ডের অধীনে ১ লাখ ৮৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। শিক্ষক রয়েছেন ১১ হাজার ৪৯১ ও কর্মচারীর সংখ্যা ৭৮৫ জন। আর প্রতিষ্ঠান রয়েছে সব মিলিয়ে ১ হাজার ১২৯টি। এর মধ্যে টাইটেল মাদ্রাসা ১১৪টি, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ৪০৮ ও হিফজ ২৮৩টি রয়েছে।
শিক্ষার্থী বাড়ার বিষয়ে মাওলানা আবদুল বছির বলেন, ‘বিগত কয়েক বছরে দ্বীনি শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ অনেক গুণ বেড়েছে। এর কারণ হচ্ছে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার উপর মানুষ বিরক্ত। সে কারণে মানুষ এখন ধর্মীয় শিক্ষার ওপর ভরসা করছেন। একটা সময় গরিবদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কওমি মাদ্রাসাকে চিহ্নিত করা হতো। কিন্তু এখন ধনীরাও তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় ভর্তি করাচ্ছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অবশ্য কওমি শিক্ষা আরো অনেক দূর এগিয়ে যেত।’
ছয়টি মূল বোর্ডের বাইরে থাকা বোর্ডগুলোর একটি কওমি মাদ্রাসা বোর্ড হবিগঞ্জ। এর অধীনেও বিগত কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আবু সালেহ সা’দী। তিনি বলেন, ‘বিগত কয়েক বছর ধরেই শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়েছে। এর একটি অন্যতম কারণ মাদ্রাসা শিক্ষার মান ভালো হয়েছে আগের চেয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীকে যা শেখানো হয় কওমি মাদ্রাসাগুলোর নূরানী পর্যায়ে তার তুলনায় কয়েক গুণ বেশি শেখানো হয়। ফলে অভিভাবকরা ধর্মীয় চিন্তা ও শিক্ষার মানের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই মাদ্রাসা শিক্ষায় আগ্রহী হচ্ছেন।’
প্রান্তিক অঞ্চলের মতো রাজধানীসহ শহরাঞ্চলের নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ এখন সন্তানকে কওমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করাচ্ছেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার একাধিক কওমি মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা গেছে, অনেক মাদ্রাসা পরিচালিত হচ্ছে বহুতল ভবনের একটি ফ্ল্যাট কিংবা ফ্ল্যাটের এক-দুটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে। এসব মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ অভিভাবকই নিম্ন আয়ের। কম খরচে পড়াশোনা ও বসবাসের ব্যবস্থা থাকায় তারা সন্তানের লেখাপড়ার জন্য কওমি মাদ্রাসাকে বেছে নিয়েছেন বলে জানান।
(মূল রিপোর্ট : বণিক বার্তা)