নিয়ন মতিয়ুল >>
সাবেক এক সহকর্মী সেদিন বললেন, ‘নিউজ আবর্জনা’ এড়ানোর উপায় নিয়ে আপনার লেখা পড়তে চাই, বস। ভাবলাম, নিউজ আবর্জনা না হয় ডাস্টবিনে ফেলা যায়, ডাম্পিং স্টেশনে পাঠানো যায়। কিন্তু ভেজাল নিউজ তো তার চেয়েও বিপজ্জনক। দেশে যে হারে ক্যানসার, কিডনি রোগসহ ভয়াবহ সব অসংক্রামক রোগ মহামারি আকার নিচ্ছে, তার পেছনে ভেজাল খাবারের বড় ভূমিকা রয়েছে।
মসজিদের শহর যখন নীতিহীন ভেজাল ব্যবসায়ীদের দখলে চলে যায়— যারা খাবারে ভেজাল-বিষ মিশিয়ে নীরব গণহত্যা ঘটায়— তখন সংবাদমাধ্যমও যে সে রোগে আক্রান্ত হবে, তার গ্যারান্টি কী! ভেজাল নিউজে পাঠক বা অডিয়েন্সের রুচির বিকৃতি ঘটানো, অপরাধ সহনশীলতা আর সাইবার বুলিং বাড়ানো, শেষ অবধি মানসিক মৃত্যুর ঘণ্টা বাজানো খুবই স্বাভাবিক।
‘সব প্রতিবেদন হুবহু’ প্রকাশ করায় ময়মনসিংহের ১১টি সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিলের ঘটনাটি ‘নিউজ আবর্জনা’ না ‘ভেজাল নিউজ’-এর ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়, বুঝতে পারছি না। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক আসিফ বিন আলী সম্প্রতি যুগান্তরের দুটি ফটোকার্ড— ‘মহিলা লীগ নেত্রীর লাশের সামনে রামদা হাতে বিএনপি নেতা!’ ও ‘হিট অফিসার বুশরার সিসা বার নিয়ে উঠে এসেছে যেসব তথ্য’—শেয়ার করে সাংবাদিকতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। যা সংবাদকক্ষের নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই ভাবতে হবে।
তার ভাষ্যে, অর্থনৈতিক চাপে আছে আজকের মিডিয়া। রিচ, শেয়ার, ক্লিক— সবই এখন টাকার ভাষা। তবে সংবাদকক্ষ যদি প্রতিদিন শিরোনামে রায় লিখতে থাকে, তাহলে আদালতের দরকার কী, তদন্তের দরকার কী? আলাপের শেষে আসিফ বিন আলী লিখেছেন, ‘ফটোকার্ডের চকচকে আবরণে যদি সত্য লুকোনো থাকে, তাহলে সেই আলো শেষ পর্যন্ত সবাইকেই অন্ধ করবে—মিডিয়াকেও, রাজনীতিকেও, সাধারণ মানুষকেও। এখন সিদ্ধান্ত সংবাদকক্ষের— তারা কি উত্তেজনার ব্যবসা করবে, না কি তথ্যের দায়িত্ব নেবে।’
মাঝখানে বছর দুয়েক দৈনিকে কাজ করার বিরতির পর একটি অনলাইন পোর্টাল ও মাল্টিমিডিয়া জয়েন করে চমকে গেলাম। শিরোনামে পাঠক আটকে ফেলার যে মারাত্মক কৌশল, তা আমার কাছে কেন যেন ‘ছিনতাই’ বা ‘চাঁদাবাজির’ মতোই মনে হতে লাগল। ডেস্কের সবাই দেখি এমন ক্লিকবেইটে মরিয়া। ভিউ-বাণিজ্য যে এতটা মহামারি আকার নিয়েছে, তা বুঝতেই পারিনি। ভাবলাম, পত্রিকাগুলো তো ভেজাল প্রচারসংখ্যার ওপর তাসের ঘরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ডিজিটাল মিডিয়া যদি এভাবে ক্লিকবেইটে পাঠক-অডিয়েন্সের আস্থার শেকড় কাটতে শুরু করে, তাহলে গণমাধ্যমের গন্তব্য কোথায়?
আগে গণমাধ্যম ছিল সাধারণ মানুষের কাছে বিধাতার মতো। সেই মাধ্যম এখন পাঠক-অডিয়েন্সের মনোযোগকে মুনাফামুখী ব্যবসার ফাঁদে ফেলেছে। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে ভেজাল, বিকৃত, প্রোপাগান্ডায় ভরে উঠছে গণমাধ্যমের মূলধারাগুলোও। ফলে উত্তেজনা ছড়ানো, অসম্পাদিত, ব্যক্তিমতনির্ভর সোশ্যাল মিডিয়াই হয়ে উঠছে মূলধারার মাধ্যম। যে মাধ্যমও আবার কলুষিত হচ্ছে ‘ভেজাল’ আর ‘আবর্জনাময়’ নিউজে। ভালো সাংবাদিকতানির্ভর টেকসই ও সুস্থ বিজনেস মডেলের বদলে গণমাধ্যম যখন ভেজাল নিউজের হঠাৎ মুনাফায় ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন অর্ধলক্ষ সাংবাদিকের জীবন-জীবিকা নিয়ে চিন্তিত হওয়া স্বাভাবিক।
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট ও বিশ্লেষক
.png) 
                     
                     
                     
                         
                                                 
                                                 
                                                 
                                                 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    