ওয়াজ ও আওয়াজের পার্থক্য, ওয়াইজ’র বৈশিষ্ট

মো. রেজাউল হক ডালিম

ওয়াজ। আরবি শব্দ। অর্থ- উপদেশ। ওয়াইজ অর্থ- উপদেশদাতা, যিনি ওয়াজ করেন। ওয়াজ ও আওয়াজের পার্থক্য, ওয়াইজ’র বৈশিষ্ট নিয়ে খুবই সংক্ষেপে কিছু বলার তাওফিক চাচ্ছি মহান রবের কাছে।

ওয়াজ কেন? এক কথায়- মানুষকে দ্বিনের পথে, হেদায়াতের পথে নিয়ে আসার জন্য। ওয়াজ কী? মানুষকে সিরাতে মুস্তাক্বিমে (সঠিক পথ) নিয়ে আসার জন্য কুরআন-হাদিসের আলোকে ‘মেদহীন’ বা অতিরঞ্জন কথন ব্যতীত আলোচনা। 

মুফাসসিরদের বক্তব্যমতে- বিশ্বমানবতার মুক্তির মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের সাড়ে ৬ হাজার আয়াতের মাঝে প্রায় ৬ হাজার আয়াতেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ওয়াজ করেছেন। এসব ওয়াজের মাঝে রয়েছে- অতীতের ইতিহাসের বিবরণ, জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনা ইত্যাদি।

স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু তা’লা যখন ওয়াজ করেছেন, তাঁর প্রিয় হাবিব আমাদের নবি হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সা.-এর দুনিয়ার জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই কেটেছে ওয়াজ করতে করতে- তখন ওয়াজ করা এবং শুনার মাঝেই কল্যাণ নিহিত। কিন্তু কল্যাণকর কাজ তখনই অকল্যাণকর হয়- যখন সেটি কুরআন-হাদিস নির্দেশিত অবস্থায় বা পন্থায় থাকে না। 

আগের সময়ের তুলনায় এখন ওয়াজ হয় বেশি। পাড়া-মহল্লায়, আনাচে-কানাচে। কিন্তু তিক্ত সত্য এটাই- এসব ওয়াজ কল্যাণের চাইতে অকল্যাণকরই বেশি। ওয়াজকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তার মূল থেকে, খোদ ওয়াইজরা-ই সরে গেছেন সিরাতে মুস্তাকিম থেকে।

কুরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা করা, মনগড়া কিসসা বলা কিংবা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গিবত চর্চার নাম ওয়াজ নয়। ওয়াজ তাহলে কী? সংক্ষিপ্তভাবে বললে- পবিত্র কুরআনের আয়াত বা রাসুলে কারিম সা.-এর হাদিসকে সামনে রেখে এগুলোর অনুবাদ; মর্মার্থ আলোচনা। ব্যাখ্যায় (তাফসিরে) গেলে- আলোচ্য আয়াত-হাদিসের বিষয়ে অতীতের অসংখ্য ইমাম, মুজতাহিদ ও মুহাক্কিক আলেমের লিখে যাওয়া গ্রন্থ থেকে উদৃতি দিয়ে  বক্তব্য পেশ করা।

কিন্তু এখন যেসব হচ্ছে- ৯০% ওয়াজ নয়, আওয়াজ। আওয়াজ কী? সুললিত কণ্ঠে কুরআনের আওয়াত ভুল পড়া (লাহনে জলি), কুরআন-হাদিসের মনগড়া ব্যাখ্যা, লম্বা টান দিয়ে কল্পকাহিনী, অশ্লীল কৌতুক, ড্যান্স, অভিনয়, গানের সুরে গজল, ১০ শব্দের বাক্যে ৭টি ইংরেজি, দেড় ঘণ্টার ওয়াজে ৭০ মিনিট হুংকার, গিবত ইত্যাদি। আর এসব ‘গুণাবলি’ যার মধ্যে বিদ্যমান- তিনিই বর্তমানে ‘আন্তর্জাতিক মুফাসসির, তারুণ্যের আইডল, ইন্টারন্যাশনাল ইলামিক স্কলার’।

আর ওয়াজের ময়দান আওয়াজের মাঠে পরিণত হওয়াতেই জাতি আরও সরছে সিরাতে মুসতাকিম থেকে, সমাজ হচ্ছে কর্দমাক্ত। সাধারণ মানুষ ভুলতে বসেছেন- ওয়াজ আসলে কী। তাই আবারও বলতে হচ্ছে- ওয়াজ মানুষের জন্য কল্যাণকর, আওয়াজ অকল্যাণকর।

ওয়াজের ময়দান এখন ব্যবসার উর্বর ভূমি! হ্যা, আবারও বলতে হচ্ছে- ওয়াজের ময়দান এখন ব্যবসার উর্বর ভূমি। ওয়াজ মাহফিলের আয়োজক এবং ওয়াইজ- দুপক্ষের জন্যই। আমরা ৩-৪ লাখ টাকা চুক্তি করেও একজন ওয়াইজকে ১-২ ঘণ্টার জন্য ভাড়া করতে শুনি। ওয়াইজ নামধারী ভাইরাল বা আলোচিত বক্তা হলে টাকার বন্দোবস্ত করা যায় বেশি। এখন ওয়াজ মাহফিলের আকর্ষণ বাড়ায়- বিদেশ থেকে আগত ইসলামিক স্কলার, রেডিও-টিভির ভাষ্যকার, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ২৬ ইঞ্চি বক্তা, শিশু বক্তা, নারী থেকে পুরুষের রূপান্তরিত বক্তা কিংবা নওমুসলিম বক্তা ইত্যাদি। ষাঁড়ের লড়াইয়ের আয়োজন আর এমন ওয়াজ (আওয়াজ) মাহফিলে ‘দানবীররা’ সমানতালে টাকা প্রদান করেন। অথচ কোনো মাদরাসার ইসলাহি মাহফিলে ১ লাখ টাকা তুলতে গেলেও পরিচালক বা মুহতামিমকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় অন্তত এক মাস।

আর যারা আওয়াজ মাহফিলে এসে মানুষকে বিনোদিত করেন- তাদের অনেকের তো ঘণ্টার মজুরি লাখ-দেড় লাখ টাকা। লাহনে জলিযুক্ত তিলাওয়াতকারী স্বঘোষিত ‘ভার্সিটির মালরা’-ও এখন ওয়াইজ কিংবা তাফসিরকারক- এই ময়দানটা ‘মাল’ কামানোর উর্বর জায়গা বলেই।

মাত্র ২০ বছর পেছন ফিরে তাকালেও দেখা যায়- মাহফিলে ওয়াইজ আসতেন পাবলিক পরিবহনে করে। পরণে সুন্নতি পোশাক। স্বর নরম। এক ঘণ্টার আলোচনা থাকতো কুরআন-হাদিসের আয়াতে ভরপুর। জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনাকালে বক্তা-শ্রোতার চোখ থাকতো অশ্রুতে টলমল। ওয়াজে কোনো অতিরঞ্জন ছিলো না। ওয়াজ শেষে দীর্ঘ মুনাজাত হতো, জীবনের গুনাহের উপর লজ্জ্বিত হয়ে- মালিকের কাছে গোলামের কান্নাময় ক্ষমা প্রার্থনায়। শ্রোতারা বাড়ি ফিরতেন ওয়াজকে নিজের মাঝে ধারণ করে। এখন দর্শকরা ফিরেন ডিজিটাল ডিভাইসে ‘সিক্সপ্যাক ভিডিও’ নিয়ে।

শেষ করছি তাবলিগের শ্রদ্ধেয় এক মুরুব্বির ওয়াজ দিয়ে। কোনো এক ইজতেমায় নসিহতকালে বিদেশি মেহমান (বক্তা) বলেছিলেন- ‘বুলেট খুবই ভয়ংকর জিনিস, প্রাণঘাতি। কিন্তু তা তখনই হয়, যখন আগ্নেয়াস্ত্রের ভেতর থেকে ট্রিগার টিপে ছোড়া হয়। অস্ত্র ব্যতীত কেউ শুধু হাত দিয়ে বুলেট অন্যের দিকে ছুঁড়লে সেটির কোনো ক্রিয়া হয় না। ওয়াজও একটা বুলেট। সেটি যদি আমলযুক্ত (প্রকৃত) ওয়াইজের (আগ্নেয়াস্ত্র) মুখ থেকে নিসৃত হয়, সেই ওয়াজ শ্রোতাদের প্রভাবিত করে- হেদায়াত উপহার দেয়।  আমল-এখলাসিয়তহীন বক্তার ওয়াজ অস্ত্রবিহীন বুলেটের মতোই।’

আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই ভয়াবহ ভাইরাসযুক্ত পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার তাওফিক দান করুন। আমিন।