কওমি কণ্ঠ ডেস্ক :
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হবিগঞ্জের চুনারুঘাট সীমান্তের কেদারাকোট এলাকার বাল্লা স্থলবন্দরটি কোনো কাজে আসছে না। ১৯ মাস আগে বাংলাদেশ অংশে অবকাঠামোগত সব কাজ সম্পন্ন হলেও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়মুড়া এলাকায় স্থলবন্দরের কোনো কাজ হয়নি। এ কারণে পুরো প্রকল্পটি ভেস্তে গেছে।
এদিকে বাংলাদেশ অংশে এই প্রকল্পের আওতায় একটি আদর্শ স্থলবন্দরের যা কিছু দরকার, তার সবকিছুই নির্মাণ করা হয়েছে। ইয়ার্ড, ওজন মাপার যন্ত্র, অফিস ভবন, ডরমিটরি, সীমানাপ্রাচীর, সড়কসহ প্রয়োজনীয় সবই আছে এখানে। পুরো টাকা খরচ করে প্রকল্পটির ইতোমধ্যে সমাপ্তি ঘোষণা করা হলেও স্থলবন্দরটি আজও চালু করা সম্ভব হয়নি। এর কারণ ভারতীয় অংশে কোনো কিছুই নির্মাণ হয়নি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ভারত অংশে স্থলবন্দরের এখন পর্যন্ত কোনো শুল্ক স্টেশন নেই। সেখানকার পুরো এলাকা খালি পড়ে আছে। নেই কোনো রাস্তাঘাটও।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই স্থলবন্দরটির প্রয়োজন ছিল না। কারণ বর্তমান বাল্লা শুল্ক স্টেশনের অবকাঠামো উন্নয়ন ও খোয়াই নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ হলেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ সহজ হতো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থলবন্দরটি নির্মাণ করা হয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী ও সাবেক নৌসচিব অশোক মাধব রায়ের বিশেষ আগ্রহে। কিন্তু ভারতীয় অংশে শুল্ক স্টেশনের অস্তিত্ব না থাকার কারণে অবকাঠামো নির্মাণের পেছনে খরচ করা অর্থের কার্যত অপচয় হয়েছে।
সূত্র জানায়, পুরো প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। উদ্দেশ্যই ছিল লুটপাট করা। অভিযোগ আছে, এই প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের টাকা নিয়েও দুর্নীতি হয়েছে। অনেকেই এখনো অধিগ্রহণের টাকা পাননি।
জানতে চাইলে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, সারা দেশের স্থলবন্দর নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। এই স্থলবন্দর থাকবে নাকি বাতিল হবে তা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর জানা যাবে।
সূত্র জানায়, ১৩ একর জমির ওপর ১৯৫১ সালে স্থাপিত চুনারুঘাট সীমান্তের বাল্লা স্থল শুল্ক বন্দর দিয়ে দীর্ঘদিন আমদানি-রপ্তানি চলছিল। কিন্তু এ বন্দরে খোয়াই নদীর ওপর সেতু না থাকায় নৌকা দিয়ে আমদানি-রপ্তানি এবং লোকজন যাতায়াত করে আসছে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব অশোক মাধব রায়ের একান্ত ইচ্ছায় নিজের এলাকায় দেশের ২৩তম স্থলবন্দরের প্রকল্প হাতে নেয় মন্ত্রণালয়।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ত্রিপুরায় অনুষ্ঠিত সীমান্ত সম্মেলনে হবিগঞ্জে একটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত-বাংলাদেশ। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা বর্তমান বন্দর থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে সীমান্তের কেদারাকোট এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে নির্মাণ কাজ শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। প্রাথমিকভাবে ৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় অবকাঠামো নির্মাণে।
ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর কেদারাকোট এলাকায় বাল্লা স্থলবন্দরের নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রত্যাশা ছিল উভয় দেশের নির্মাণকাজ সমানভাবে এগিয়ে গেলে ২০২৪ সালের মধ্যেই বন্দর চালু হবে। কিন্তু স্থলবন্দরের বিপরীতে ভারতের ত্রিপুরা সরকার তাদের পাহাড়মুড়া এলাকায় এখনো নির্মাণকাজ শুরু করতে পারেনি। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর গত বছরের আগস্ট মাসে স্থলবন্দরের এসব চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দেন বাল্লা স্থলবন্দরের কর্মকর্তারা। ওই চিঠিতে দ্রুত বিষয়টি ভারতের নজরে আনার তাগিদ দেওয়া হয়।
জানা গেছে, সীমান্তের ওপারে ভারতের পাহাড়মুড়া এলাকায় কোনো শুল্ক স্টেশন না থাকায় প্রকল্পটি কোনো কাজে আসছে না। এটি জানা সত্ত্বেও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের করের টাকা খরচ করেছে। এদিকে নামমাত্র কাজ দেখিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী ও হবিগঞ্জ সদর আসনের এমপি আবু জাহিরের অনুসারী ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা জমি কেনাবেচায় এই টাকা আত্মসাৎ করেন। এতে সহযোগিতা করেন নৌসচিব অশোক মাধব।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রকল্পের ভারত অংশে এখনো কোনো কাজ শুরু হয়নি। প্রস্তাবিত জায়গায় গাছগাছালি ও ঝোপঝাড় । এ বিষয়ে ভারতের ত্রিপুরার পাহাড়মুড়া এলাকার আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি স্বপন সাঁওতাল জানান, তাদের অংশে এখনো কোনো কাজ শুরু হয়নি এবং ভারতের এই অংশে রাস্তার তেমন সুবিধা নেই। তবে জায়গা অধিগ্রহণ নিয়ে কথাবার্তা চলছে বলে জানান তিনি। মহাসড়ক থেকে পাহাড়মুড়ায় যাওয়ার তেমন কোনো সুবিধা নেই। বর্তমানে চিকন একটি হাঁটার পথের মতো আছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, স্থলবন্দর এরিয়ার দেয়ালের ভেতর এখনো ১৭টি পরিবার বসবাস করছেন। বন্দরের ভেতরের বাসিন্দা চোকেরা বেগম বলেন, ১০০ বছরের ওপরে আমরা বসবাস করি এখানে। কিন্তু আমাদের জমিজমা নিয়ে গেছে সরকার। এখন পর্যন্ত কোনো টাকা-পয়সা পাইনি। তাই আমরা বন্দরের এরিয়ায় বসবাস করছি। টাকা-পয়সা না পেলে আমরা ঘর-বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না। এ ছাড়া জমি অধিগ্রহণের পরও অনেকেই টাকার জন্য জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ধরনা দিচ্ছেন বলেও জানা গেছে।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী আমার দেশকে বলেন, নতুন যে স্থলবন্দরটি কেদারাকোট এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে তার প্রয়োজন ছিল না। কারণ বর্তমান বাল্লা শুল্ক স্টেশনের অবকাঠামো উন্নয়ন ও খোয়াই নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ হলেই কাজ হয়ে যেত। মোহাম্মদ আলী বলেন, বাল্লা স্থলবন্দরের এই প্রকল্পে ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে। জনগণের অর্থের অপচয় হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করার প্রকট দৃষ্টান্ত এটি। এতে অনেকেই আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন, কেউ অন্যভাবে লাভবান হয়েছেন। যিনি এই প্রকল্প পাসে প্রভাব খাটিয়েছেন, তার যেমন দায় আছে; তেমনি যারা প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদেরও দায় আছে। তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।
মূল রিপোর্ট : আমার দেশ